হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দাজ্জাল কেন সবচেয়ে বড় সঙ্কট?

এমামুযযামান মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী:

মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ফেতনা, আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকারকারী এবং মানবজাতির রব দাবিদার দাজ্জাল সম্পর্কে রসুলাল্লাহ যে সকল ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন সেগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক এবং উদ্বিগ্নকর। রূপকভাবে বর্ণিত সেই হাদিসগুলোকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করলে বর্তমান ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতারই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমাম, এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী কোর’আন-হাদিস-বাইবেল থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে, পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ইহুদি-খ্রিষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতাই হলো রসুলাল্লাহ বর্ণিত সেই দাজ্জাল। এখানে দাজ্জালের গুরুত্ব সম্পর্কিত একটি হাদিসকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার পরিচিতি আলোচনা করা যাক। আল্লাহর রসুল বলেছেন আদমের সৃষ্টি থেকে নিয়ে শেষদিন (অর্থাৎ কেয়ামত) পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে ও ঘটবে তার মধ্যে দাজ্জালের চেয়ে বড় আর কিছু ঘটবে না। [ইমরান বিন হুসাইন (রা.) থেকে মুসলিম]
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিস, কারণ দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্বের কথা বোঝাতে যেয়ে বিশ্বনবী শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘আকবর’, অতি বড়। আরও গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে আদমের (আ.) সৃষ্টি থেকে কেয়ামত অর্থাৎ মানবজাতির সৃষ্টি থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সর্ববৃহৎ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হওয়াটা কম কথা নয়, নিঃসন্দেহে বলা যায় সাংঘাতিক, কারণ মানবজাতির জীবনে নুহের (আ.) সময়ে মহাপ্লাবনে সমস্ত পৃথিবী ডুবে যেয়ে মানবজাতিসহ সব প্রাণী, পশুপক্ষী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দু’টি বিশ্বযুদ্ধে অল্প সময়ের মধ্যে কমপক্ষে চৌদ্দ কোটি মানব হতাহত হয়েছে, ইতিহাসের আগে আরও অমন সর্বনাশা বিপর্যয় হয়তো হয়েছে। অথচ মহানবী বলছেন, ওসব কিছুর চেয়েও সাংঘাতিক ব্যাপার হবে দাজ্জালের আবির্ভাব। মানবজাতির অতীতে কী কী ঘটনা ঘটেছে তা আল্লাহ তাঁর রসুলকে জানিয়ে দিয়েছেন, কোর’আনই তার প্রমাণ আর ভবিষ্যতে কী কী ঘটবে তাও যে তাঁর রসুল জানতেন তার প্রমাণ দাজ্জাল ও অন্যান্য বহু ব্যাপার সম্বন্ধে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী। দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্বের কথা বলার সময় অতীতে নুহের (আ.) মহাপ্লাবনের কথা বা ভবিষ্যতে বিশ্বযুদ্ধের কথা তাঁর মনে ছিল না এ কথা অসম্ভব। কারণ তিনি সাধারণ লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর রসুল, তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি শব্দ ভেবেচিন্তে বলা। কাজেই এ এক সাংঘাতিক ভবিষ্যদ্বাণী এবং এমন মানুষের ভবিষ্যদ্বাণী যা অব্যর্থ, মিথ্যা হতেই পারে না। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সম্বন্ধে আমরা বেখেয়াল, উদাসীন কিন্তু এর চেয়ে তুচ্ছ হাজারও বিষয় নিয়ে তুলকালাম করছি। এবার দেখা যাক দাজ্জাল অর্থাৎ জড়বাদী, যান্ত্রিক ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার আবির্ভাব মানবজাতির জীবনে সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে বিপজ্জনক ঘটনা কেন? এর গুরুত্ব ঠিকভাবে বুঝতে গেলে আমাদের আদমের (আ.) অর্থাৎ মানবজাতির সৃষ্টির সময়ে ফিরে যেতে হবে।
মহাকাশ, সেই মহাকাশে অগণ্য ছায়াপথ, নীহারিকা, অসংখ্য সূর্য, চাঁদ, গ্রহ, এক কথায় এই মহাবিশ্ব- আজ পর্যন্ত যার শেষ পাওয়া যায়নি, তা শুধু ‘কুন’ আদেশ দিয়ে সৃষ্টি করার পর আল্লাহর ইচ্ছা হলো এমন একটি সৃষ্টি করার যার মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকবে। এই বিপুল, বিরাট মহাবিশ্বের প্রতি অণু-পরমাণু তাঁর বেঁধে দেওয়া নিয়মে চলছে, ঐ নিয়ম থেকে একটি চুলের কোটি ভাগের এক ভাগও সরে যাবার ক্ষমতা বা শক্তি কারো নেই, সে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি কাউকে আল্লাহ দেন নি। এ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি তিনি তাঁর মালায়েকদেরও দেন নি; যে মালায়েক অর্থাৎ ফেরেশতার ওপর যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তা থেকে এক পরমাণু পরিমাণও ভ্রষ্ট হবার শক্তি তাদের দেন নি। এবার তাঁর ইচ্ছা হলো তাঁর নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি তাঁর কোনো সৃষ্ট জীবকে দিয়ে দেখা ঐ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নিয়ে সে কি করে (কোর’আন- সুরা দাহর, আয়াত ২, ৩)। তাই আল্লাহ সৃষ্টি করলেন আদমকে (আ.)। যেহেতু এর দেহের ভেতর তিনি তাঁর নিজের আত্মা স্থাপন করবেন, সেই সম্মানে আদমের দেহ তিনি তৈরি করলেন ‘কুন’ আদেশ দিয়ে নয়, তাঁর নিজের হাতে (কোর’আন- সুরা সা’দ, আয়াত ৭৫)। তারপর তার দেহের মধ্যে আল্লাহ তাঁর নিজের আত্মা থেকে ফুঁকে (প্রবেশ কোরিয়ে) দিলেন (কোর’আন-সুরা হেজর, আয়াত ২৯; সুরা সাজদা, আয়াত ৯; সুরা সা’দ, আয়াত ৭২)। আল্লাহ তাঁর নিজের আত্মা, যেটাকে তিনি বলছেন- আমার আত্মা, সেটা থেকে আদমের মধ্যে ফুঁকে দেওয়া অর্থ আল্লাহর কাদেরিয়াত অর্থাৎ যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসহ আল্লাহর সমস্ত সিফত, গুণ, চরিত্র আদমের মধ্যে চলে আসা। আল্লাহর রূহ্ আদমের অর্থাৎ মানুষের ভেতরে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে অন্যান্য সমস্ত সৃষ্ট জিনিসের চেয়ে বহু ঊর্ধে উঠে গেল, কারণ তার মধ্যে তখন স্বয়ং আল্লাহর সমস্ত সিফত্সহ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এসে গেল যা আর কোনো সৃষ্টির মধ্যে নেই। সেই সাথে আদমের ভেতরে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা বা অস্বীকার করার ক্ষমতাও এসে গেল। আর একারণেই মালায়েকরা মানুষ সৃষ্টির বিরুদ্ধে মত দিয়েছিল। তারা যথোপযুক্ত যুক্তিই আল্লাহকে দেখিয়েছিল যে এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ফলে মানবজাতি যদি আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে বসে তাহলে তারা অনিবার্য কারণবসতই ফাসাদ সাফাকুদ্দিমা অর্থাৎ অন্যায়-অবিচার এবং যুদ্ধ-রক্তপাতে পতিত হবে। কিন্তু তাদের আপত্তিকে উপেক্ষা করে যখন আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন এবং তাঁর নিজের আত্মা থেকে ফুঁকে দিলেন তখন সে হয়ে গেলো আশরাফুল মাখলুকাত, সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানিত। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসহ আল্লাহর রূহ্ যে তিনি মানবের দেহের ভেতর স্থাপন করলেন এটাই হলো মানুষের কাছে তাঁর আমানত, যে আমানত মানুষ ছাড়া আর কারো কাছে নেই (কোর’আন- সুরা আহযাব, আয়াত ৭২)।
অতি সংক্ষেপে এর পরের ঘটনাগুলি হচ্ছে এই যে, আদমের (আ.) অর্থাৎ মানুষের দেহ নিজ হাতে তৈরি করে তার দেহের ভেতরে আল্লাহর নিজের রূহ্, আত্মা থেকে ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ মালায়েকদের আদেশ করলেন আদম অর্থাৎ মানুষকে সাজ্দা করতে (কোর’আন- সুরা বাকারা, আয়াত ৩৪; সুরা আ’রাফ, আয়াত ১১)। এবলিস অস্বীকার করল ও আল্লাহকে বললো- আমরা মালায়েকরা বলেছিলাম তোমার এই নতুন সৃষ্টি এই আদম, তোমার এই খলীফা পৃথিবীতে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার আর যুদ্ধ, মারামারি, রক্তপাত করবে। আমাদের এই কথা যে সত্য তা প্রমাণ করে দেখাবো। আল্লাহ এবলিসের অর্থাৎ শয়তানের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন, কারণ তাঁর খলীফা সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল তাই- পরীক্ষা করা যে তাঁর স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিধর খলীফা কোন্ োপথে চলে তা দেখা। এবলিসের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তিনি এই নতুন খেলার নিয়ম-কানুন, শর্ত ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দিলেন। সেগুলো হলো মোটামুটি এই:-
ক) এবলিসকে অনুমতি ও শক্তি দেওয়া গেলো যে সে আল্লাহর খলীফা আদমের দেহে, মন-মগজে, শিরা-উপশিরায় প্রবেশ করতে পারবে ও তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিতে পারবে।
খ) আল্লাহ যুগে যুগে পৃথিবীর প্রতি জনপদে তাঁর নবী-রসুলদের পাঠিয়ে
মানুষকে হেদায়াহ অর্থাৎ পথ প্রদর্শন করবেন (কোর’আন- সুরা ইউনুস, আয়াত ৪৭; সুরা নহ্ল, আয়াত ৩৬; সুরা রা’দ, আয়াত ৭)। সে হেদায়াহ হলো তওহীদ, জীবনের সর্বস্তরে, সর্ব অঙ্গনে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধ অস্বীকার করা এবং একমাত্র তাঁরই আদেশ-নিষেধ পালন করা।
এরপর বনি আদমের সম্মুখে সমষ্টিগত জীবন পরিচালনার জন্য দু’টি মাত্র পথ খোলা রইলো। হয় আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নবী-রসুলদের মাধ্যমে প্রেরিত আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধানকে (দীন) সমষ্টিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা করে সেই মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা অথবা এবলিসের পরামর্শ মেনে নিয়ে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে নিজেদের অর্থাৎ মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিজেরাই আইন-কানুন তৈরি করে সেই মোতাবেক সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা করা। তৃতীয় কোনো পথ রইল না। যুগে যুগে মানবজাতি প্রথম পথ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকেই মেনে নিয়ে সেই মোতাবেক তাদের সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা করে এসেছে। আল্লাহর পাঠানো দীনের আইন কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি ধর্মজীবী পুরোহিত শ্রেণির কবলে পড়ে কখনও কখনও বিকৃত হয়ে গেছে, আকিদা হারিয়ে গেছে কিন্তু সেগুলোকেও মানবজাতি স্রষ্টার বিধান বা নির্দেশ মনে করেই পালন করে এসেছে। স্রষ্টার হুকুমের বাইরে কোনো হুকুম মানবসমাজ কখনও গ্রহণ করে নি। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে মানবজাতির সার্বভৌমত্ব থেকেছে স্রষ্টার হাতেই। কিন্তু রসুলাল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক আমরা জানতে পারি যে দাজ্জালই হবে একমাত্র শক্তি যে কিনা সরাসরি আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে নিজেকে সার্বভৌমত্বের মালিক দাবি করবে। মানবজাতিকে সে বাধ্য করবে তাকে রব বলে মেনে নিতে। এবং আশ্চর্যজনক হলেও একথা সত্য যে, মানবজাতি তাকে রব হিসেবে মেনে নিয়ে তার পায়ে সেজদায় প্রণত হবে। আর এটাই হবে মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুতর এবং সঙ্কটজনক ঘটনা। কারণ এই কাজের ফলশ্র“তিতে এবলিস যে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল- সে সমস্ত মানবজাতিকে বিপথে পরিচালিত করবে, আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করাবে এই চ্যালেঞ্জে এবলিস পুরোপুরি জয়ী হবে আর আল্লাহ পরাজিত হবে। তাই দাজ্জালের আবির্ভাব হচ্ছে মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে সঙ্কটজনক এবং গুরুতর ঘটনা। আজকে পৃথিবীতে কোথাও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নেই, সর্বত্র দাজ্জালকেই হুকুমদাতা, এলাহ হিসাবে মানা হচ্ছে। যার ফল হচ্ছে দুনিয়াময় চরম অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, রক্তপাত, যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ এক কথায় ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা। সুতরাং আজ এবলিস বিজয়ী, আল্লাহ পরাজিত।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...