হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জঙ্গিবাদ: স্রষ্টা পশ্চিমা বিশ্ব, শিকার মোসলেম বিশ্ব পর্ব: ০৫

রিয়াদুল হাসান পর্ব: ০৫
নির্যাতিত মোসলেম ঘুরে দাঁড়ালেই ‘সন্ত্রাসী’
জঙ্গিদের আত্মঘাতী হামলা একটি আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বিষয়। কিন্তু যুদ্ধে আত্মঘাতী হামলা নতুন কোনো কৌশল নয়, এটা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। তবে ইসলামের নামে যে আত্মঘাতী হামলা চালু হয়েছে এর সূতিকাগার ফিলিস্তিন। প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের ট্যাংক আর জঙ্গি বিমানের বিরুদ্ধে গুলতি আর ইট পাথর ছুঁড়ে যুদ্ধ করেছে, এই দৃশ্য বিশ্বের মানুষ প্রতিদিন দেখেছে। ফিলিস্তিনিদেরকে নিজেদের ভূমি থেকে বিতাড়ন করে দেওয়া হয়েছে। তারা যখন দেখেছে যে তাদের মা-বোনের ইজ্জত হরণ করা হচ্ছে, তাদের বাবা-মা আর নিষ্পাপ শিশুদের প্রাণহীন টুকরো টুকরো দেহ নিয়ে মিছিল করতে হচ্ছে, তখন যে প্রতিশোধের আগুন তাদের হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে সেটাই তাদেরকে আত্মঘাতী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাদের নিজেদের জীবনকে তারা তুচ্ছ করতে শিখেছে। তাদের এই দৃষ্টান্ত পৃথিবীময় হাজার হাজার মুসলমান যুবককে বুকে বোমা বাঁধার প্রেরণা যুগিয়েছে। এরাই দেশে দেশে জঙ্গি দলগুলিতে নাম লেখাচ্ছে।
আজকে সারা পৃথিবীতে যত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে তার জন্য সর্বপ্রথম সন্দেহ করা হয় মুসলমানদেরকে, কারণ এখন ইসলাম আর সন্ত্রাসকে প্রায় সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি পরিসংখ্যান নিয়ে বসি, দেখব পৃথিবীতে গত শতাব্দীতে যত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে তার সিংহভাগই করেছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী সংগঠনগুলি। এদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলি অনেকাংশেই রাষ্ট্র-প্রণোদিত (State-sponsored terrorism) অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, উত্তর কোরিয়া, কলম্বিয়া ইত্যাদি সাম্যবাদী রাষ্ট্রগুলির ফরেন পলিসির অন্তর্ভুক্ত। অ-রাষ্ট্রীয় বড় বড় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির মধ্যে আছে ইতালির রেড ব্রিগেড, ফ্রন্ট লাইন, জার্মানির রেড আর্মি ফ্যাকশন ইত্যাদি। এদেরই ভাবধারায় আমাদের উপমহাদেশেও বহু সাম্যবাদী সন্ত্রাসী দল যেমন কমুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া ও নকশাল (মাওবাদী), তামিল টাইগার, বাংলাদেশের সর্বহারা ইত্যাদি। এদের অপরাধের নমুনা দেখলে গা শিউরে ওঠে। অথচ বিশ্বের প্রধান দশটি সন্ত্রাসী দলের তালিকায় একটিমাত্র সমাজতান্ত্রিক দলের নাম রয়েছে, Forças Armadas Revolucionárias da Colômbia – FARC, যার অবস্থান সপ্তম স্থানে, বাকি সবগুলি ইসলামিক। আর এফ.বি.আই-এর প্রকাশিত টপ টেররিস্ট তালিকায় ২২ জনের নাম রয়েছে যাদের সকলেই মুসলমান (সূত্র: Most wanted terrorists list released”. CNN. October 1, 2001. Retrieved July 18,2008.)।

আমার বক্তব্য থেকে যেন কেউ ধারণা না করেন যে, আমি জঙ্গিদের পক্ষে সাফাই গাইছি। ধর্ম-বর্ণ-মতবাদ নির্বিশেষে সকল সন্ত্রাসীই মানবজাতির শত্র“, কাউকেই এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। আমার কথা হচ্ছে, এখন টার্গেট কম্যুনিজম ধ্বংস করা নয়, ওটা অর্জিত হয়ে গেছে। এখন টার্গেট হচ্ছে ইসলাম, তাই তাদের সামান্য অপরাধও বিরাট করে তুলে ধরা হচ্ছে। এসব কারণেই আজকে দুনিয়া জোড়া যুদ্ধ, বিক্ষোভ, সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে মোসলেম জনগোষ্ঠী, তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকেও জঙ্গিবাদী বলে আখ্যায়িত করে নিন্দা করা হচ্ছে। এজন্য বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে, এই মুসলমানদের উপর বিগত তিনশত বছরে কী পরিমাণ নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে, সেটা যারা চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে তারা সবাই দুধে ধোয়া তুলসি পাতা। জমিদারের হাতে নিজের বাড়ি-ঘর সম্পত্তি সব হারিয়ে উদ্বাস্তু উপেন যখন দীর্ঘদিন পরে নিজের হারানো ভিটা দেখতে ফিরে এলো, নিজের হালে লাগানো আমগাছের নিচে বসে নিজের ছেলেবেলার কতশত মধুর স্মৃতি তার মনে ভেসে উঠতে থাকে। বাতাসের ঝাপটায় একটি আম ঝরে উপেনের সামনে পড়ে। শ্রান্ত উপেন আমটি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে চায়। এ সময় জমিদারের লোকেরা উপেনের দিকে তেড়ে আসে আর তাকে আমচোর বলে ভর্ৎসনা করতে থাকে। তখন উপেন স্বগোতক্তি করেছিল-
শুনে আমি হাসি, আঁখিজলে ভাসি- এই ছিল মোর ঘটে!
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।
আজ সিরিয়ায় যে জঙ্গিবাদী বিদ্রোহীরা একনায়ক বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, গণহত্যা চালাচ্ছে তাদেরকেও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করছে ব্রিটেন। এই অন্যায় পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে কিছুদিন আগে পদত্যাগ করলেন কনজারভেটিভ পার্টির রাজনীতিক, পার্লামেন্টেরিয়ান ও মন্ত্রী ব্যারোনেস সাইয়েদা ওয়ার্সী। আজ যুক্তরাষ্ট্র যে আই.এস এর বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে নেমেছে সেই আই.এস.-ই কিছুদিন আগে সিরিয়ায় বিদ্রোহীদলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তখন তারাও পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্য পেয়েছে। এভাবেই পশ্চিমা পরাশক্তিগুলি সৃষ্টি করেছে জঙ্গিবাদ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর জিইয়ে রাখছে বিশ্বজোড়া অস্ত্র ও ধর্মব্যবসার জমজমাট বাজার। 
আরববিশ্বের মোনাফেকি ও ধর্মব্যবসার কদর্যতা
সৌদি আরবকে যদি কেউ ইসলামের ধারক বা রক্ষক বলে মনে করে তবে সে বোকার স্বর্গে বাস করছে। ব্রিটিশ-মার্কিন জোট যেভাবে আজ বিশ্বময় জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছে, ঠিক কয়েক শতাব্দী আগে ব্রিটিশরাই মুসলমানদের ওহাবি বলে একটি ফেরকার সৃষ্টি করেছে। আরবের রাজপরিবার এই ওহাবি ফেরকার অনুসারী, যারা মূলত পশ্চিমা বিশ্বের অধীন গোলাম ও অর্থযোগানদাতামাত্র।
আগেই বলেছি, আফগানিস্তানে ইসলামকে কট্টরবাদীদের হাতে তুলে দেবার পেছনে ঈওঅ আর আই.এস.আই- এ দু’টি সংস্থা দায়ী। আর এই দুই সংস্থার পেছনে যে সব মোসলেমপ্রধান দেশের নেতাদের নাম জড়িত রয়েছে তারা হলো জিয়াউল হক, বাদশাহ ফাহাদ আর আনোয়ার সাদাত। সোভিয়েতবিরোধী জেহাদে সৌদি আরব ওয়াহাবী আন্দোলনকে আফগানিস্তানে প্রাধান্য দিয়েছে আর তাই আব্দুল রসুল সাইয়াফের মতো সৌদি আরবে বসবাসরত আফগান পশতুনকে দিয়ে ওয়াহাবী গরিষ্ঠ মোজাহেদ দল ইত্তেহা-ই-ইসলামী এর মতো কট্টরপন্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। দশ বছর সময়ের মধ্যে এ ওয়াহাবী আন্দোলন বেশ শক্তি সঞ্চয় করে। এই ওয়াহাবী আন্দোলনকে সাধারণ আফগানেরা সহজভাবে নেয় নি, কারণ তাদের মতে এ আন্দোলন আফগানদের উপরে কৌশল চাপানোর প্রচেষ্টা ছিল মাত্র। এ কারণে সৌদি সরকার প্রচুর অর্থ খরচ করেছে। উল্লেখ্য, ওসামা বিন লাদেন এবং তার সৌদি অনুগামীরা ওয়াহাবী সম্প্রদায়ভুক্ত।
ইসলামের নামে যেসকল ধর্মব্যবসা আজ বিশ্বময় চলছে সেগুলির সূতিকাগার ও পোষকদেহ এই সৌদি আরব ও তাদের প্রভাবাধীন আরববিশ্ব। ‘আল্লাহর রসুল সেই দেশে এসেছিলেন’-শুধু এই ইতিহাসটুকুকে ভাঙ্গিয়ে তারা এই ধর্মব্যবসাগুলি চালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ তাদেরকে অঢেল সম্পদ দিয়েছেন, এ সম্পদ ব্যয় করার জায়গা তারা পাচ্ছে না। সেই সম্পদ ভোগ করার জন্য লালায়িত ওহাবিরা ব্যক্তিস্বার্থে পাশ্চাত্যের যে কোনো হুকুম প্রভুভক্ত পশু-বিশেষের মতো পালন করে, লাথি খেয়েও প্রভুর পদলেহন করে যায়। এই দেশগুলির বাদশাহ ও আমীরদের এলাহ হলো তাদের যার যার সিংহাসন ও আমিরত্ব। এই সিংহাসন ও আমিরত্বের নিরাপত্তার জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের ও ইউরোপের কথায় ও আদেশে উঠেন বসেন, অন্য মোসলেম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন। মুখে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে লোক দেখানো চিৎকার করলেও কার্যত ইসরাইলের ক্ষতি হবে এমন কোনো কাজ করেন না, ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন না। কারণ তা করতে গেলে প্রভু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বিরক্ত হবে এবং তাতে তাদের সিংহাসন ও আমিরত্ব হারাতে হতে পারে। যদি এমন কোনো পরিস্থিতি কখনও হয় যে তাদের সিংহাসন বা আমিরত্ব রক্ষা এবং কাবা ধ্বংস করা এ দু’টোর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে, তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ধর্মব্যবসায়ী পথভ্রষ্ট এই আরবরা কাবা ধ্বংসকেই বেছে নেবেন!
মনে রাখতে হবে, ইসলাম নয় কেবল, কোনো ধর্মেই ধর্মব্যবসা বৈধ নয়। কারণ ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণের জন্য, কেউ যদি একে ব্যবসায়ের মাধ্যমে পরিণত করে তবে স্বভাবতই এটি বিকৃত হয়ে যাবে, এটা দিয়ে আর মানুষের কল্যাণ হবে না, শান্তি আসবে না। ধর্ম প্রেরণের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে এই পশ্চিমা ‘সভ্যতা’ মোসলেম দেশগুলিকে দখল করে সেখানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে এমন এক বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে যেটা দিয়ে ঐ আলেম মোল্লাদের রুজি-রোজগারের চেয়ে বেশি কিছু হওয়া সম্ভব নয়, সমাজে শান্তির আসার চিন্তাও সুদূর পরাহত (অবশ্য ধর্মের কাছে শান্তির আশা আজ আর কেউ করেও না)। তারা ঐ মাদ্রাসাগুলিতে কর্মমুখী কোনো শিক্ষা না দেয়ায়, দুনিয়াবি জ্ঞান বিজ্ঞানের কোনো শিক্ষা না দেয়ায় মাদ্রাসাশিক্ষিত মানুষগুলোর ধর্ম বেচে খাওয়া ছাড়া আর কোনো পথও রইল না। যতদিন মানুষ ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবে ততদিনই এই ধর্মব্যবসায়ীরা কিছু করে খেতে পারবে, এজন্যই তারা ধর্মকে নিজেদের হাতছাড়া করতে চায় না। তারা নিজেদের ধর্মীয় বিকৃতজ্ঞানকে জাহির করার জন্য যত্রতত্র ফতোয়াবাজি, ওয়াজ নসিহত করে। তাদের এইসব ওয়াজ-নসিহত ও ফতোয়াবাজি দ্বারা জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি নেতিবাচক ফ্যাক্টরগুলি বিস্তারলাভ করে। যেমন, ধর্মীয় স্বরগ্রামে (ঞড়হব) কথা বলে তারা খুব সহজেই মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাফের, নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ জনতাকে উন্মাদ করে দিতে পারে, এভাবে তারা মানুষ হত্যা, ভাঙ্গচুরসহ যে কোনো ভয়াবহ সহিংসতা ঘটাতে পারে। বলা বাহুল্য যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলির পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন থাকলেও নেতৃত্ব দেয় ধর্মব্যবসায়ীরাই। কাজেই জঙ্গিবাদ যেমন পশ্চিমাদের সৃষ্টি তেমনি ধর্মব্যবসাও তাদেরই সৃষ্ট হাতিয়ার বিশেষ। এই দু’টি মারাত্মক ব্যাধি মোসলেম দুনিয়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। (চলবে. . . . )

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...