হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ: ইসলামী দৃষ্টিকোণ

মোহাম্মদ আসাদ আলী:
চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদ যা-ই বলা হোক না কেন, এটি বর্তমানে মানবজাতির অন্যতম সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে পৃথিবীর পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি পশ্চিমা ভাবধারার গণমাধ্যমগুলো সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনসমর্থন সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে তারা যেভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে, তাতে কেবল চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নয়, ক্ষেত্রবিশেষে ইসলামের বিরুদ্ধেও মানুষের মনে ঘৃণাবোধ জন্ম নিচ্ছে। বিশ্বময় ইসলামের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মূল্যবোধ, সংস্কৃতি বা পরিচয়জ্ঞাপক বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, মুসলিম দেখলেই তার গায়ে থু থু দিচ্ছে, কোর’আন পোড়াচ্ছে, মসজিদ মানেই জঙ্গি আস্তানা মনে করা হচ্ছে, মিনার ভেঙ্গে ফেলার আন্দোলন হচ্ছে, কারো নামে মুসলমানিত্বের চিহ্ন থাকলে তাকে যতদূর সম্ভব হয়রানি করা হচ্ছে। এভাবে সন্ত্রাসবাদের ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে ১৬০ কোটি মুসলিমকেই। তাই চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে এখন আর কেবল রাজনীতিক বিষয় ভেবে দূরে সরিয়ে রাখলে চলছে না, সর্বশ্রেণির মানুষকেই এর মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যেমন:
সন্ত্রাসবাদ কী?
সন্ত্রাসবাদ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে কোথায়?
ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি করল কারা?
এই কাজে কীভাবে ‘আলেমদের’ ব্যবহার করা হয়েছে?
সন্ত্রাসবাদের ফসল উঠছে কার ঘরে, আর কে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত?
ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসবাদ কেন অবৈধ?
সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের সঠিক পন্থা কী?
সন্ত্রাসের অর্থ ও সংজ্ঞা:
সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল প্রসঙ্গে মূল বক্তব্যে যাবার আগে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অর্থ ও সংজ্ঞা জেনে নেওয়া আবশ্যক। সন্ত্রাস শব্দটি বাংলা ‘ত্রাস’ শব্দ হতে উদ্ভূত, যার অর্থ ভয়, ভীতি, শঙ্কা। (ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯২, পৃ. ৫৭৩)। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে, ‘সন্ত্রাসবাদের কোনো সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য সরকার ও বে-সরকারি উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে এই শব্দ প্রয়োগ করে। ডানপন্থী, বামপন্থী, জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয়, বিপ্লবী ও ক্ষমতাসীন দল সকলেই তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় নিয়ে থাকে বলে অভিযোগ করা হয়।’ (Encyclopædia Britannica. p. 3. Retrieved 2015-01-07)।
‘ইউ এস কোড অব ফেডারেল রেগুলেশানস’ সন্ত্রাসবাদের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা হলো- ‘যে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে সরকার, জনগণ বা কোনো গোষ্ঠীর উপর অবৈধভাবে শক্তি প্রয়োগ করা বা তাদের সম্পদের উপর হামলা করে ভীতি সৃষ্টি করা।’ (The unlawful use of force and violence against persons or property to intimidate or coerce a government, the civilian population, or aû segment thereof, in furtherance of political or social objectives.’
এছাড়া ২০০৯ সালে প্রণীত আমাদের দেশীয় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে যে, ‘‘কেহ বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করিবার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতংক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে কোনো কার্য করিতে বা করা হইতে বিরত রাখিতে বাধ্য করিবার উদ্দেশ্যে- (ক) কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করিলে, বা কোনো ব্যক্তির কোনো সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করিলে; অথবা (খ) দফা ‘ক’ এর উদ্দেশ্য সাধনকল্পে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য বস্তু, আগ্নেয়াস্ত্র বা অন্য কোনো প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করিলে বা নিজ দখলে রাখলে তিনি সন্ত্রাসী কার্য সংগঠনের অপরাধ করিবেন।’’
সন্ত্রাসের যে অর্থ ও সংজ্ঞা আমরা পেলাম, এর কোথাও কি নিদ্রিষ্ট কোনো ধর্ম, বর্ণ, দল, মতাদর্শের নাম রয়েছে? কোনো নিদ্রিষ্ট ধর্ম-বর্ণের মানুষ এই কাজগুলো করলে সে সন্ত্রাসী বিবেচিত হবে, কিন্তু অন্যরা করলে সন্ত্রাসী হবে না এমনটা বলার সুযোগ থাকল কি? তারপরও সন্ত্রাসবাদ শব্দটির সাথে বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেবল ইসলাম ধর্মের অনুসারীদেরকে জড়িত করে দেওয়ার প্রবণতা (Tendency) লক্ষ করা যায়, যদিও সন্ত্রাসের সাথে ইসলামের দূরতম সংযোগও কোনোকালে ছিল না এটা ইতিহাস। পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের শাস্তি ও পরিণতি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় সন্ত্রাসমূলক কাজ করে বেড়ায় এটা তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের মহাশাস্তি রয়েছে।” (আল-কুরআন, ৫: ৩৩) তাহলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইসলামের চাইতে বেশি কঠোর কেউ আছে কি?
প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসবাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ঘাঁটলে ইউরোপের দিকেই অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করতে হয়। নির্ভরযোগ্য তথ্যভাণ্ডার ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ও অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ইংলিশ’ এ বলা হচ্ছে- ‘১৮ শতাব্দীর ফরাসি বিপ্লবের সময়ে টেররিস্ট ও টেররিজম শব্দদ্বয় সৃষ্টি হয়েছে। তবে রোনাল্ড রিগানের শাসনামলে ১৯৮৩ এর বৈরুত ব্যারাক বোমা হামলা, ২০০১ এর নিউইউর্ক ও ওয়াশিংটনে হামলা ও ২০০২ এ বালি হামলার পর এ শব্দদুটোর ব্যাপক প্রসার শুরু হয়। (The terms “terrorist” and “terrorism” originated during the French Revolution of the late 18th century but gained mainstream popularity during the U.S. Presidency of Ronald Reagan (1981–89) after the 1983 Beirut barracks bombings and again after the attacks on Nwe York City and Washington, D.C. in September 2001and on Bali in October 2002.)
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদ মুসলিমদের নয় পশ্চিমাদেরই একটি ঐতিহাসিক কালো অধ্যায়ের নাম। পরবর্তীতে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হলে ইসলাম ও মুসলিম জাতির উপর সন্ত্রাসবাদের তকমা বিশেষভাবে লেপে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং এমনভাবে পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষী গণমাধ্যম বিষয়টি উপস্থাপন করতে থাকে যেন মনে হয় ইসলামের নামেই প্রথম সন্ত্রাসবাদের উত্থান হলো, এর আগে ‘সন্ত্রাস’ বা ‘চরমপন্থা’র কোনো অস্তিত্বই ছিল না! কেউ মনে করবেন না যে, ইসলামের নামে সন্ত্রাস হচ্ছে এটাকে আমি অস্বীকার করছি। মোটেও তা নয়, আমার কথা ইসলামের নামে যেমন সন্ত্রাস হচ্ছে, মুসলমানদের একটি শ্রেণি তা করছে, তেমনি অমুসলিমদের মধ্যেও অতীতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে এবং এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। কাজেই সন্ত্রাসবাদের জন্য শুধুমাত্র যেন ইসলামকে দায়ী করা না হয় ও মুসলিমদেরকে নির্বিচারে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেওয়া না হয় । তারপরও প্রশ্ন থাকে- যে ইসলাম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এত কঠোর, সেই ইসলামের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছেই বা কীভাবে?
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের গোড়ার কথা:
প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোই এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে জঙ্গিবাদ ইস্যুটির জন্ম দিয়ে তা বিশ্বময় রপ্তানি করেছে এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এর স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য ছিল পররাজ্য দখল করা, পরসম্পদ লুট করা আর দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য ছিল ‘কম্যুনিজমের’ পতনের পর একমাত্র প্রতিদ্ব›দ্বী ‘ইসলাম’-কে ধ্বংস করে দেওয়া। এর স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্যটি নিয়ে আলোচনার তেমন প্রয়োজন নেই, এ বিষয়ে বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি উক্তিই যথেষ্ট হবে আশা করি। তিনি ২৩ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ সূচনা করে মুসলিম বিশ্বকে পদানত রাখার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে। দেশটি আফগানিস্তানে যুদ্ধের সূচনা করে, তা এখন সম্প্রসারিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে।” এ যুদ্ধে পক্ষে-বিপক্ষে মুসলিম দাবিদারদেরকেই ব্যবহার করা হচ্ছে অবিশ্বাস্য ক‚টকৌশলে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এ এক ভয়াবহ নীতি। তারা একদিকে জঙ্গিদেরকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের এ কর্মপন্থা দেখে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে যে, আসলে তারা জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন চায়, নাকি এটা তাদের রাজনীতির খেলামাত্র (Political game)? আমাদের দেশের অর্থনীতিকে যেমন বলা হয় কৃষি অর্থনীতি, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বলা হচ্ছে যুদ্ধ অর্থনীতি (War Economy), অস্ত্র ব্যবসা তাদের আসল ব্যবসা। যুদ্ধ না থাকলে তারা সঙ্কটে পড়বে, তাদের প্রয়োজন বিশ্বজোড়া অস্ত্রের বাজার। তারা চায় যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে, কিন্তু তাদের সৈন্যরা যুদ্ধবিমুখ ও ভোগবাদী। তাই দরকার পড়েছে মুসলিমদের একটি দলকে আরেকটি দলের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়া। জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে একটার পর একটা দেশ এভাবেই তারা দখল করে নিয়ে পা চাটা পুতুল সরকার বসাচ্ছে। সুতরাং জঙ্গিরা পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে অতি প্রয়োজনীয় শত্রু (Useful enemy)। অনেক দেশের সরকারও জঙ্গিবাদ নির্মূল হোক এটা চায় না, জঙ্গিরা থাকলে তাদের বহুমুখী স্বার্থোদ্ধারের পথ খোলা থাকে। কিন্তু সত্যিকারভাবে যারা মানুষের কল্যাণকামী এবং যারা ইসলামপ্রিয় তাদেরকে বুঝতে হবে যে, এ জঙ্গিবাদ পাশ্চাত্যের গর্ভে জন্ম নেওয়া ইসলামের শত্রু। জঙ্গিবাদের অজুহাত দিয়ে যে পরিমাণ মুসলিম হত্যা করা হয়েছে এবং ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম বলে পরিচিত করা সম্ভব হয়েছে আর কোনো উপায়ে সেটা সম্ভব হয় নি। তাই সাম্রাজ্যবাদীরা উপরে উপরে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও জঙ্গিবাদকে তারা নিজেদের স্বার্থেই ধ্বংস হতে দেবে না, জঙ্গিবাদ না থাকলে অস্ত্র ব্যবসাই তো বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু যারা প্রকৃতই মানুষ, যাদের মধ্যে মানুষের ধর্ম মানবতাবোধ কাজ করে তাদের উচিত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। নয়তো এই ইস্যুকে ব্যবহার করে আরো লক্ষ লক্ষ মানুষকে হতাহত ও বাস্তুহারা করবে পশ্চিমা ‘সভ্য’ দেশগুলো।
ষড়যন্ত্রের রঙ্গমঞ্চ আফগানিস্তানে ধর্মের অপব্যবহার:
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একই পক্ষে থেকে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু যুদ্ধের শেষে তারা নিজেরাই হয়ে দাঁড়াল একে অপরের প্রতিদ্ব›দ্বী তথা ঘোরশত্রু। কারণ উভয়ের হাতেই আছে পারমাণবিক অস্ত্র আর এক বনে দুই বাঘ থাকতে পারে না। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারল না কেবল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই, যাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় দাতাঁত (Deterrent)। তারা শুরু করল ক‚টনৈতিক দাবাখেলা, যার নাম দেওয়া হলো ঠান্ডা যুদ্ধ (Cold war)। এই ঠান্ডাযুদ্ধ কিন্তু সব জায়গায় ঠান্ডা থাকে নি, কোথাও কোথাও তা শ্যুটিং ওয়ারেও রূপ নিয়েছে- যেমন আফগানিস্তান। কম্যুনিস্ট মতবাদকে ভূলুণ্ঠিত করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত শাসনাধীন এলাকার মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতি ও স্বাধীনতার চেতনাকে কম্যুনিস্ট নাস্তিক্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করল। আফগানিস্তানে এক দশক দীর্ঘস্থায়ী যে যুদ্ধ (১৯৭৯-১৯৮৯) হয় সেটা ছিল কোল্ড ওয়ারেরই অন্তর্ভুক্ত। এটি বাহ্যত ছিল আক্রমণকারী রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের কম্যুনিস্ট-বিরোধী গেরিলাদের যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে আফগানিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করে।
ভৌগোলিক স্বাধীনতা বা ভূখণ্ডরক্ষার যুদ্ধগুলোতে অধিকাংশ জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য ঐ জাতির মধ্যে বিরাজিত বিভিন্ন চেতনাকে কাজে লাগানো হয়। যেমন কেউ কেউ বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়েছেন, যেমন: নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং প্রমুখ। কেউ কেউ ভাষাকে কাজে লাগিয়েছেন, কেউ কাজে লাগিয়েছেন ধর্মকে। কিন্তু আদতে এ সবই ছিল জাতীয় অধিকার আদায় বা স্বাধীনতার আন্দোলন, কেবল যেখানে যে ফ্যাক্টরটা বেশি ফলপ্রদ সেখানে সেটাই ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধিকার আন্দোলনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছাড়াও হিন্দু, মুসলিম, শিখ জাতীয়তাবাদী সহিংস/অহিংস দল অনেক ছিল। ক্রুসেডের সময় ইউরোপীয় জাতিগুলোকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করার জন্য খ্রিষ্টধর্মকে ব্যবহার করেছিল রাজ্যগুলোর রাজন্যবর্গ ও ধর্মব্যবসায়ীরা। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগানদেরকে এই অসম যুদ্ধে লিপ্ত করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র ধর্মকে ব্যবহার করেছে।
জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে ‘আলেমদের’ ব্যবহার:
কয়েকটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র এবং আমেরিকার যৌথ প্রযোজনায় আফগানিস্তানের পার্বত্যভূমিতে যে রক্তাক্ত নাটক মঞ্চায়িত হয়েছিল তার কুশীলব ছিল কেবল আফগান চরমপন্থীরা। পুঁজিবাদী আমেরিকা দেখল আফগানিস্তানের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদেরকে কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে খুব সহজেই জিহাদের কথা বলে উদ্বুদ্ধ করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধরাশায়ী করা সম্ভব। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা আরবীয় মিত্র দেশগুলোর সহযোগে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে এমন কিছু ধর্মব্যবসায়ী ভাড়া করল যাদের দায়িত্ব ছিল মুসলিম তরুণদেরকে জিহাদের কথা বলে উদ্বুদ্ধ করে আফগানিস্তানের যুদ্ধভূমিতে যেতে উৎসাহিত করা। তাদের কথায় উৎসাহিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার তরুণ আফগানিস্তানে ছুটে গেল ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ’ করার জন্য। আর পর্দার আড়াল থেকে তাদের অস্ত্র, অর্থ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত ও বিতাড়িত হলেও এই ‘জিহাদী চেতনা’ কিন্তু শেষ হলো না বরং আরও ধারালো হলো। কথিত জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই লোকগুলো নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে ছোট ছোট দল গঠন করল নিজেদের দেশে কিতাল করার উদ্দেশ্যে। সে সময় আমাদের বাংলাদেশেও রাজপথে স্লোগান দেওয়া হয়েছিল ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। এদিকে ফিলিস্তিন, জিনজিয়াং, কাশ্মীরসহ পৃথিবীর যেখানে যেখানে মুসলিমরা দুর্দশার মধ্যে রয়েছে সেখানেও আফগানফেরত ঐ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণরা জিহাদী চেতনায় ছুটে যেতে লাগল, হামলা-পাল্টা হামলা চালাতে থাকল। শুরু হলো একদিকে জঙ্গিবাদী তাণ্ডব, অন্যদিকে জঙ্গি দমনের নামে দেশ দখলের মহোৎসব। টুইন টাওয়ারে হামলা হলো, আফগানিস্তানের পর ইরাক দখল করে নেওয়া হলো। লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্ত ঝরল মার্কিন সেনার হাতে। এসব অন্যায়-অবিচার দেখে আরও হাজার হাজার তরুণ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে লাগল। যারা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান তারা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ইতিকথা – আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। আমরা কেবল ধারণা দেওয়ার জন্য বইটির ১২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখকৃত কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি, “(মার্কিন প্রেসিডেন্ট) কার্টারের রুশবিরোধী দল পাকিস্তান, মিশর আর সৌদি আরবের সাহায্য সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিতই ছিল। এ উপদেষ্টাদের এখন প্রয়োজন, এ যুদ্ধে তিনটি উপকরণের, অর্থ, জনবল আর অস্ত্রের নিশ্চয়তা। এগুলোর সমন্বয়েই এ যুদ্ধ পরিচালিত হবে। প্রাথমিকভাবে ঈওঅ এবং পরে ধনী মুসলিম দেশগুলোকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এরপরে রয়েছে জনবল। বেশিরভাগ যোদ্ধা আফগান আর পাকিস্তানের সীমান্ত থেকেই আসবে, সে সাথে অন্যান্য মুসলিম দেশ এবং বিভিন্ন স্থানের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সংগ্রহ করে এ যুদ্ধের জনবল যোগাড় হবে। এ যুদ্ধের জন্যে রাশিয়ার তৈরি অস্ত্র যোগাড় করে পরে এ ধরনের অস্ত্র তৈরি করবার উপযুক্ত দেশ খুঁজতে হবে। প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তানের আফগানিস্তান সংলগ্ন স্থানগুলো উত্তম বলে বিবেচিত হয়েছিল, তাই সাব্যস্ত হলো এর দায়িত্ব ঈওঅ-র তত্ত¡াবধানে ওঝও এ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করবে। মোটামুটি এই ছিল সোভিয়েতবিরোধী জেহাদের পরিকল্পনার মোটা দাগগুলো।”
এই যে বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে লাখ লাখ যুবক আফগানিস্তানে ছুটে গিয়েছিল আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য, তারা কি বুঝেছিলেন যে, এটা জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ নয়, এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাথের্র যুদ্ধ, এ যুদ্ধে আল্লাহ-রসুলের কিছু আসে যায় না? বুঝতে পারেন নি, কারণ এই যুবকদেরকে প্রাণদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে হাজার হাজার ধর্মব্যবসায়ীকে ভাড়া করেছিল যারা তাদের যার যার দেশের যুবকদেরকে যুদ্ধে যোগদানের জন্য উত্তেজিত ও সংঘটিত করেছিল। তারা বলত যে এটা যুদ্ধ নয়, জেহাদ ও কেতাল ফি-সাবিলিল্লাহ।
প্রাগুক্ত গ্রন্থে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন, “আফগান জেহাদে যোগদানকারী আরবদের মধ্যে মিশরের জেহাদিদের সংখ্যায় ছিল বেশি। এর কারণ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ইসলামের পুনঃজাগরণের প্রচেষ্টার সাথে মিশরের উত্তর হতে দক্ষিণ পর্যন্ত গোপন সংস্থাগুলো তৎপর রয়েছে বেশি। তদুপরি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাপীঠে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে ছাত্ররা একত্রিত হয় উচ্চ শিক্ষার জন্যে। এখানে পরিচিত হয় ইসলাম প্রবর্তনের তথাকথিত অগ্রগামী ধর্মীয় গুরুদের সাথে।”
জঙ্গিবাদের স্রষ্টা যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ প্রভৃতি বিশ্বমোড়ল এ বিষয়টি এখন এতই সুস্পষ্ট যে বিষয়টিকে ওপেন সিক্রেট বললেও বেশি বলা হয়। আফগানিস্তানে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে যে মোজাহেদরা এসেছিলেন তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেন, আব্দুল্লাহ আজ্জাম প্রমুখ যারা আজ মিডিয়ার বদৌলতে ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণিত ব্যক্তি। এমনিভাবে আজকের যত সন্ত্রাসী নেতাদের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই আফগান ছায়াযুদ্ধের (চৎড়ীু ধিৎ) অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রাক্তন অথবা নবীন যোদ্ধা। মার্কিনি গোয়েন্দা সংস্থা ঈওঅ এই সব স্বেচ্ছাসেবী মোজাহেদদের তালিকা সংরক্ষণ করত যে ডেটাবেইজ-এ, সেই কম্পিউটার ফাইলটির নাম ছিল “আল কায়েদা”, যার আক্ষরিক অর্থই হচ্ছে ডেটাবেইজ, বেইজ বা ভিত্তি। সুতরাং আল কায়েদা কোনো বিশেষ সামরিক দলের নাম ছিল না, আফগানিস্তানে লড়াই করতে আসা সকল মোজাহেদরাই ছিল আল কায়েদা নামক তালিকাটির অন্তর্ভুক্ত। Co-operative Research History Commons. Retrieved January 9, 2007.- এর বিবরণে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, A CIA program called ÒOperation CycloneÓ channeled funds through Pakistan’s Inter-Services Intelligence agency to the Afghan Mujahideen who were fighting the Soviet occupation. CIA and British Recruit and Train Militants Worldwide to Help Fight Afghan War.
অর্থাৎ অপারেশান সাইক্লোন নামে CIA-র একটি কর্মসূচি ছিল যা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আফগান মোজাহেদিনদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করত। CIA এবং ব্রিটিশ আফগান যুদ্ধের জন্য সারা বিশ্ব থেকে ‘মিলিট্যান্ট’ (জঙ্গি) রিক্রুট করেছে এবং তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তুলেছে।
এই যে ‘প্রশিক্ষণ’, এটা দিয়েছিল কিন্তু দাড়ি টুপিধারী জবরদস্ত আলেমরা-মোল্লারাই। কিন্তু এই লোকগুলো যে ঈওঅ-র নিয়োজিত সেটা কি এই আল্লাহর জন্য আত্মোৎসর্গকৃত মোজাহেদরা বুঝতে পেরেছিলেন? পারেন নি। কী নিষ্ঠুর প্রতারণা! দুঃখে হৃদয় ভেঙ্গে যায়। যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র দিল কিন্তু একটাও প্রাণ দিল না। প্রাণ দিল বোকার হদ্দ আবেগপ্রবণ পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক, মূল্যহীন খেলনারূপী মুসলিমরা। যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেল, আফগান মোজাহেদরা নিজেদেরকে জয়ী ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জয়ী হলো যুক্তরাষ্ট্র। বহিরাগতরা যার যার দেশে ফিরে গেলেন। তখন তারা আফগানফেরতা মোজাহেদ, ‘জেহাদি জোশে’ উদ্দীপ্ত, ইসলামের জন্য জীবনপণ সংগ্রামের বাসনা তখনও বুকের মধ্যে জাজ্বল্যমান।
সাফল্যের সঙ্গে জঙ্গিবাদ রপ্তানি করল পশ্চিমা বিশ্ব:
এই যে আফগানফেরতা যোদ্ধারা যার যার দেশে ফিরে গেলেন, সেখানে গিয়ে তারাও ছোট ছোট দল গঠন করতে লাগলেন অথবা পূর্বে থাকা কোনো ইসলামী দলে যোগ দিয়ে তার গতিপথকে প্রভাবিত করতে লাগলেন। বিশ্বের যতদেশে মুসলিম আছে মোটামুটি সবদেশেই এমন দলের সৃষ্টি হলো। উইকিপিডিয়ার একটি অসম্পূর্ণ তালিকায় বর্তমানে সক্রিয় সশস্ত্র ইসলামী দলের নাম পাওয়া যায় ১০৪টি। তাদের উদ্দেশ্য প্রধানত ভৌগোলিক স্বাধীনতা হলেও ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রেরণাই তাদেরকে শক্তি যুগিয়েছে। আফগান জেহাদের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের একটি বড় উদাহরণ চেচনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলিম আন্দোলন। প্রথম ও দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় প্রায় তিন লক্ষ চেচেন মুসলিম।
আরেক ট্রাজেডি অনুষ্ঠিত হয় চীনের উইগুড়ে। আফগান জেহাদের সূচনালগ্ন থেকেই চীন তার নিজস্ব ভূকৌশলগত কারণে আফগানসংলগ্ন সিনজিয়াং প্রদেশের মুসলিম-প্রধান উইগুড় অঞ্চল এবং পাকিস্তানের আরো উত্তরোস্থিত রাশিয়ান কিরগিজ মুসলিমদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে আরম্ভ করে। এই প্রশিক্ষণ এবং জেহাদিদের অস্ত্রায়নসহ যাবতীয় বিষয়ে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পূর্ণ খরচ ঈওঅ বহন করে। এ সময়ে চীন প্রায় ৫০,০০০ মোজাহেদদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। এই প্রশিক্ষণার্থী মুসলিম সন্তানেরা একবারও ভাবল না যে, কম্যুনিস্ট দানব সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে এসেছে আরেক কম্যুনিস্ট দানব চীন, এখানে তারা কেন জীবন দেবে? যদি সোভিয়েত হারেও জয়ী হবে আমেরিকা-চীন, মুসলিমদের কী লাভ? কিন্তু এসব ভাবার অবসর তাদের হয় নি, এটাই ইতিহাস। ঈওঅ-র কাছে আত্মবিক্রিত আলেমদের হৃদয় কাঁপানো উদ্দীপক ওয়াজে তারা জেহাদের জন্য এতটাই উদ্বুদ্ধ যে তাদের এই সাধারণ জ্ঞানও লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল যে তাদের যুদ্ধ আল্লাহর রাস্তায় হচ্ছে না, উল্টো তারা এবং ইসলাম উভয়েই পরিণত হয়েছে দুই দানবের যুদ্ধের হাতিয়ারে। এই দানবেরা চায় না এ যুদ্ধে নিজেদের লোকক্ষয় হোক, এজন্যই মূল্যহীন মুসলিমদেরকে এত প্রশিক্ষণ দেয়ার ঘটা। মুসলিমদেরকে দিয়ে যুদ্ধ করাতে প্রয়োজন তাদের ধর্ম ইসলামের। তাই যখন যুদ্ধ শেষ হবে, তখন ইসলাম ও মুসলিমরা ধ্বংস হলেও তাদের কিছু এসে যায় না, বরং ধ্বংস হওয়াই বুদ্ধিমান শত্রুর কাম্য হওয়া স্বাভাবিক।
নিষ্ঠুর পরিহাস হচ্ছে, সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তান ত্যাগের পর সেই চীনারা এখন ঠিকই যুদ্ধ করছে। তবে সেটা করছে সেই উইগুড় মুসলিম জেহাদিদের বিরুদ্ধেই, যাদেরকে তারা নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি বানিয়েছে। এজন্য তারা একটি অজুহাত দাঁড় করিয়েছে যে উইগুড় মুসলিমদের এ বিচ্ছিন্নতাবাদ আন্দোলনে তালেবানরা সহযোগিতা করছে। এ অভিযোগ তুলে ২০০১ সনে আবার চীন আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী জোটের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে যারা উভয়েই কিছুদিন আগে ছিল মুসলিমদের ‘পরম বন্ধু’।
১৯৮৫ সনের মাঝামাঝি ওসামা বিন লাদেনের সান্নিধ্যে আফগান জেহাদে সামিল হবার জন্য ঈওঅ-এর হিসাব অনুযায়ী আরব-মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যথা সৌদি, ইয়ামেন, আলজেরিয়া, মিশর, তিউনেশিয়া, ইরাক, লিবিয়া, জর্ডান থেকেই এসেছিল ১৫,০০০ জেহাদি। পরে এ সংখ্যা বেড়ে ৩০,০০০ ছাড়িয়ে যায়। আফগান যুদ্ধের শেষে এদের মধ্যে এক থেকে দেড় হাজারের মতো আলজেরিয়ার সরকারবিরোধী ইসলামী কট্টরপন্থী বলে কথিতদের সাথে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রণের জন্য আলজেরিয়ায় চলে আসে। ১৯৯২-৯৮ পর্যন্ত চলমান এ গৃহযুদ্ধে প্রায় ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) লোকের প্রাণহানি হয়।
এদিকে আফগান ফেরত যোদ্ধারা মিশরে ফিরে আল-জেহাদ এবং আল জামিরার মতো সংগঠনগুলোতে যোগ দেয়। এর মধ্যে প্রায় ২০০ আরব-আমেরিকান স্পেশাল ফোর্স দ্বারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত আফগান জেহাদ ফেরত সদস্যরা নিউ ইয়র্কের নিউজার্সি এরিয়াতে ফিরে আসে। ক্রমেই আল-কায়েদা আর তালেবান একই সূত্রে সমগ্র মধ্য এশিয়ায় জেহাদের প্রতীকরূপে গড়ে ওঠে। এদের যোদ্ধারা আজারবাইজান থেকে শুরু করে চেচনিয়া, নগরনো-কারাবাগ, কিরগিজিস্তান, তাজাকিস্তান, দাগেস্তান এবং উইগুড়সহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আফগান মোজাহেদরাও কোনো না কোনো পর্যায়ে কাশ্মিরে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়লে পাক-ভারত সম্পর্ক অবনতির নিম্নধাপে পৌঁছে। (দেখুন: আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ইতিকথা: আফগানিস্তান হতে আমেরিকা – ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন)
বাংলাদেশ কীভাবে জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে?
আমাদের দেশের নব্বই ভাগ মানুষ নিজেদেরকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করে। তারা আল্লাহ ও রসুলকে ভালোবাসে। জিহাদী চেতনা আমাদের দেশের মানুষেরও আছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিগত দিনগুলোতে ইসলামের নামে এখানেও গড়ে উঠেছে শত শত রাজনৈতিক দল, উপদল, প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কোনোটা যেমন উদারপন্থী, তেমনি উগ্রপন্থী চেতনায় বিশ্বাসী দল বা সংগঠনও রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুকেন্দ্রিক বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, মিছিলে এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও প্রায়ই মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র চর্চার নামে যুগের পর যুগ ধরে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিভক্তি, হানাহানি ও নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি বিরাজ করে আসছে- এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও জঙ্গিবাদের উত্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে।
এসব কারণে বাংলাদেশ বরাবরই জঙ্গিবাদ ও সাম্রজ্যবাদী আগ্রাসনের একটি ঝুঁকির মধ্যে ছিল। তথাপি একটা সময় পর্যন্ত আমরা জঙ্গিবাদকে কেবল গুটিকতক দেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট বা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্কট মনে করে নিশ্চিন্তে থাকতে পেরেছি। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ একেবারেই নেই। ইতোমধ্যে আমরা আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানার আত্মাঘাতী হামলাগুলো সারা বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা পৌঁছে দিচ্ছে তা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত। গত কয়েক যুগের ঘটনা পরিক্রমা এই সাক্ষ্যই দেয় যে, কোনো দেশে একবার আত্মঘাতী হামলা আরম্ভ হলে সেই দেশ দ্রুত অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। হাজারো সামরিক অভিযান চালিয়েও তা রোধ করা আর সম্ভব হয় না।
জঙ্গিবাদের সমাধান কী?
শুধু শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব নয়। এর প্রথম কারণ- জঙ্গিবাদ আদর্শিক বিষয়। যারা জঙ্গি হচ্ছে তারা একটি ভ্রান্ত আদর্শকে সঠিক মনে করে সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে তাদের ধর্মীয় আবেগ ও ঈমান জড়িত। তারা যা করছে পার্থিব লাভের আশায় করছে না, পরকালীন প্রতিদানের আশায় করছে, যদিও ভুল পথে গন্তব্যে পৌঁছা যায় না।
এমতাবস্থায় শুধু শক্তি প্রয়োগ করলে একে ঈমানী পরীক্ষা মনে করায় তাদের ঈমান আরো বলিষ্ঠ হচ্ছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেই চেতনা প্রবাহিত হচ্ছে। এই ধর্মীয় চেতনাকে অবজ্ঞা করে এতদিন অনেকেই জঙ্গিবাদের উৎপত্তির কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন অশিক্ষা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ইত্যাদির কারণে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে তারা জঙ্গিবাদের দিকে পা বাড়াচ্ছে। কিন্তু এই অনুমানগুলো ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোতে ইংলিশ মিডিয়াম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রভাবশালী বিত্তবান ঘরের সন্তানেরা অংশ নেওয়ায় এখন অনেকেই বুঝতে পারছেন জঙ্গিরা কোনো পার্থিব স্বার্থের জন্য ওই পথে যায় না। প্রকৃতপক্ষে জঙ্গিবাদের সাথে মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট জড়িত এবং এই সেন্টিমেন্ট এতটাই শক্তিশালী যে জেল-ফাঁসির ভয় করা তো দূরের কথা, জঙ্গিরা এই পথে মৃত্যুবরণ করতে পারাকেই বিরাট সৌভাগ্য মনে করে। তাই জাতিসংঘের মহাপরিচালক বান কি মুনকে বলতে শুনি, ‘জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থায় জঙ্গিবাদ আরো বেড়েছে’। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, ‘কেবল অস্ত্র দিয়ে জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয়’ (প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর ২০১৬)।
দ্বিতীয় কারণ- জঙ্গিবাদের স্রষ্টা প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যে কথা পূর্বেই বলে এসেছি। তারা জঙ্গিবাদের ইস্যুকে জিঁইয়ে রেখে বিশ্বময় নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এজন্য মানবতার যতই বিপর্যয় ঘটুক না কেন, সেটা এই দানবিক পরাশক্তিগুলোর জন্য কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। তাদের চাই তেল, গ্যাস, আধিপত্য, অস্ত্রব্যবসার জমজমাট বাজার এবং শক্তিশালী প্রভাব বলয় (Predominance)। কাজেই এই পরাশক্তিগুলোকে অনুসরণ করে যদি শুধুমাত্র বল প্রয়োগে জঙ্গিবাদ দমনের বা নির্মূলের চেষ্টা চালানো হয়, সেটা কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনবে না।
আদর্শিক লড়াইয়ের বিকল্প নেই:
এখন সমাধান একটাই, আর সেটা হলো- সঠিক আদর্শ দিয়ে ভ্রান্ত আদর্শ জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করতে হবে। যারা জঙ্গিবাদের পক্ষে প্রচার প্রচারণা চালায়, তারা কোর’আন হাদিস, ইতিহাস ইত্যাদি থেকে নানা যুক্তি, তত্ত্ব ও তথ্য তুলে ধরে মানুষকে জঙ্গি হতে প্ররোচিত করে। তাদের সেই যুক্তিগুলোকে যদি ভ্রান্ত হিসাবে প্রমাণ করা যায় তাহলে অবশ্যই কেউ আর জঙ্গিবাদের দিকে যাবে না এবং ইতোমধ্যেই যারা সে পথে পা বাড়িয়েছে তারাও যদি বুঝতে পারে যে এ পথ তাদের দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই ধ্বংস করছে তাহলে তারাও সংশোধিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কথা এখন অনেকেই বলছেন, জঙ্গিবাদ একটি আদর্শ তাই একে মোকাবেলা করতে পাল্টা আদর্শ (Counter Narratives) লাগবে এবং সেটা সেক্যুলার আদর্শ দিয়ে হবে না, ধর্মীয় আদর্শ হতে হবে। আমাদের দেশের সাবেক বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ.ল.ম ফজলুর রহমানও জঙ্গিবাদ মোকাবেলা সম্পর্কে এই একই যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “রাজনীতিকে যেমন রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে, ইসলামের মধ্যে যারা জঙ্গিবাদ নিয়ে আসছে তাদেরকে কোর’আন-হাদিস দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। সেক্যুলারিজম দিয়ে মোকাবেলা করে আপনি পারবেন না। কারণ তারা সেক্যুলারিজমকে একটি চ্যালেঞ্জিং পার্টি মনে করে অর্থাৎ হয় তারা জিতবে আপনি হারবেন অথবা আপনি হারবেন তারা জিতবে। এভাবে এটাকে আপনি মোকাবেলা করতে পারবেন না।” (চ্যানেল আই-তৃতীয় মাত্রা, ১৯ অক্টোবর ২০১৫)। একইভাবে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘জঙ্গিরা বা সন্ত্রাসবাদীরা যেহেতু ডগমা বেইজড বা আইডিওলজি বেজড, তো এটাকে মোকাবেলা করতে গেলে ট্যাক্টিক্যালি শুধু গ্রেফতার কিংবা জেলে ভরে সাজা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই একে মোকাবেলা করা কঠিন। একটা স্ট্র্যাটেজি থাকা দরকার, যে স্ট্র্যাটেজির কমপোনেন্ট থাকবে একটা কাউন্টার র‌্যাডিকেলাইজেশন, যেটা প্রিভেনশনের কাজ করবে যেন নতুন করে র‌্যাডিকেলাইজড না হতে পারে, বা যারা ইতোমধ্যেই র‌্যাডিকেলাইজড হয়েছে কিন্তু সরাসরি টেরোরিস্ট অ্যাক্টিভিটিস এ অংশগ্রহণ করে নি, তাদেরকে ফিরিয়ে আনা। সেটা কাউন্টার ন্যারেটিভস প্রদানের মাধ্যমে তাদের ন্যারেটিভটাকে মোকাবেলা করে ফিরিয়ে আনার কাজ, যেটা আসলে সরাসরি ল’ অ্যান্ড ইনফোর্সমেন্টের কাজ নয়।’’ (২২ জানুয়ারি, ২০১৭, টকশো- ‘মুখোমুখী’, চ্যানেল ২৪)
আদর্শিক লড়াই কেন ও কীভাবে?
সমস্ত রকম পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে ইসলামের নামে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটার পর থেকে আজ পর্যন্ত যেখানেই চরমপন্থার বিরুদ্ধে বেশি শক্তিপ্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে সন্ত্রাসী হামলার পরিমাণ তত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা প্রমাণ করে যে, জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে আগে আদর্শিক লড়াইয়ের দ্বারা জঙ্গিবাদকে ভুল প্রমাণ করতে হবে। এতে জঙ্গিরা যুদ্ধের প্রেরণা হারিয়ে ফেলবে এবং তাদের রিক্রুটমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। তারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দ্বারা ধিকৃত ও প্রত্যাখ্যাত হবে, তারা গণপ্রতিরোধের সম্মুখীন হবে। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে মতবাদভিত্তিক সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলার জন্য গণপ্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। প্রাচীন চীনা সমরবিদ ও সেনানায়ক সান যুু (Sun Tyu) বলেছিলেন, “To fight and conquer in all your battles is not supreme excellence; supreme excellence consists in breaking the enemy’s resistance without fighting অর্থাৎ “যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় লাভ করাই চূড়ান্ত শ্রেষ্ঠত্ব নয়, শত্রুর প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বিনা যুদ্ধে তছনছ করে দেওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব। আদর্শিক লড়াই (The Battle of Ideas) হচ্ছে শত্রুর প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বিনা যুদ্ধে তছনছ করে দেওয়ার একটি কার্যকরী পদ্ধতি। এই আদর্শিক লড়াইয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের পাল্টা আদর্শটি কেমন হতে পারে তার একটি সম্যক চিত্র আমি সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব এখন। নিম্নে বর্ণিত যুক্তি, তথ্য ও তত্ত্ব গুলো ধর্মবিশ্বাসী জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে পারলে আশা করা যায় মানুষ জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদের অসারতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
চরমপন্থীদের দুনিয়া এবং আখেরাত উভয়ই ব্যর্থ, কারণ…
প্রথমত, তারা বিকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। তারা যেটাকে ইসলাম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে সেটা আল্লাহ ও রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। ওটা প্রতিষ্ঠা করলে শান্তি আসবে না, তাই তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানে শান্তি আসে নি, উল্টো মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তারা বোমা মেরে বামিয়ানের বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক মানুষের হৃদয়ে দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। তাদের পশ্চাৎপদতা ও কূপমণ্ডূকতা বিশ্ববাসীর চোখে ইসলামকে আদিম, বর্বর ধর্ম হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে। আইএস ইসলামের নামে জীবন্ত বেসামরিক মানুষকে ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে পুড়িয়ে ও জবাই করে হত্যা করেছে এবং হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য ভিডিওধারণ করে প্রকাশ করেছে। সারা বিশ্বের মানুষ ঐসব ভিডিও দেখেছে আর ছি ছি করেছে। এভাবে তারা ইসলামের যে ক্ষতি করেছে কোটি কোটি ইসলাম-বিদ্বেষীও তা করতে পারত না। সুতরাং যেটা ইসলামই না, সেটার জন্য যারা জীবন দেবে তাদের আত্মদান ব্যর্থ। দ্বিতীয়ত, জঙ্গিদের জেহাদ ও কেতাল সম্পর্কে ধারণা ভুল হওয়ায় তাদের গৃহীত ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটাও হচ্ছে ভুল। তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সেটা আল্লাহর রসুলের কর্মসূচি নয়। এজন্য তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। স্বভাবতই ব্যর্থতা পুরস্কারযোগ্য নয়, উপরন্তু তাদের কারণে ইসলামের গায়ে যে কালিমালিপ্ত হচ্ছে সেটার জন্য ইতিহাস তাদেরকে ক্ষমা করবে না। যারা এই ভুল পথে পা বাড়িয়েছে এখন সময় তাদের সামনে সঠিক পথটি তুলে ধরা, তাতে তারা সংশোধিত হবে।
জঙ্গিবাদের উত্থানের পর থেকে ইসলামবিদ্বেষী মানুষেরা জেহাদকে ‘সন্ত্রাস’ বলে চালিয়ে জেহাদের বিরুদ্ধে মানসিকতা গড়ে তুলতে চান। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে আজ জনারণ্যে সত্য প্রতিষ্ঠার জেহাদ ও কেতালের সাথে সন্ত্রাসকে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। অথচ এগুলো সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। জেহাদ মানে যেকোনো উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, সর্বাত্মক সংগ্রাম করা; আর সন্ত্রাস হচ্ছে হিংসাত্মক কাজ করে, বোমা ফাটিয়ে, ধ্বংস করে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করা। আল্লাহর পথে জেহাদ অর্থ নিজের স্বার্থ না ভেবে মানুষের কল্যাণের জন্য, মানবতার মুক্তির জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এটাই করেছেন সকল নবী-রসুল-অবতারগণ। মানুষের কল্যাণের জন্য সংগ্রাম ব্যতিরেকে ইসলামই অসম্পূর্ণ; কারণ ঈমানের সংজ্ঞার মধ্যে, মো’মেন হবার সংজ্ঞা, শর্তের মধ্যেই আল্লাহ এই জেহাদ অর্থাৎ সত্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে অঙ্গীভূত করে রেখেছেন (কোর’আন, সুরা হুজরাত, আয়াত ১৫)। সমস্যা হচ্ছে, বর্তমানে জেহাদ বলতেই যুদ্ধ বোঝানো হয় কিন্তু আসলে তা নয়। বই লিখে, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে, মুখে বলে বুঝিয়ে অর্থাৎ যে যেভাবে পারে অসত্য বিলোপ করে সত্য প্রতিস্থাপনের চেষ্টাই জেহাদ, আর যুদ্ধ হচ্ছে জিহাদের একেবারে চূড়ান্ত ধাপ- কিতাল, এটা ব্যক্তির দায়িত্ব নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
রসুল (সা.) যখন মক্কায় সত্য প্রতিষ্ঠার জেহাদে আত্মনিয়োগ করলেন অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্তে¡ও তিনি অস্ত্রধারণ করেন নি, সকল অপমান নির্যাতন সহ্য করে সত্য প্রচার করে গেছেন। রসুলাল্লাহ যদি একবার বলতেন, কে আছো আবু জেহেলের জবান চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারো? কোনো সাহাবি কি বসে থাকতেন? কিন্তু রসুলাল্লাহ সেটা বলেন নি। এমনকি একবার এক মহিলা সাহাবিকে কাফেররা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল হত্যা করার উদ্দেশ্যে। ওমর (রা.) রসুলাল্লাহর কাছে উক্ত সাহাবিকে উদ্ধার করে আনার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রসুলাল্লাহ অনুমতি দিলেন না, বললেন, ‘ধৈর্য ধরো।’ অর্থাৎ রসুলাল্লাহ আক্রমণের শিকার হয়েও, আত্মরক্ষার জন্যেও অস্ত্রের সংস্পর্শে গেলেন না। এর কারণ কী? কারণ তিনি সেখানে একজন ‘ব্যক্তি’, সাধারণ নাগরিক। ব্যক্তি কখনও যুদ্ধ করতে পারে না। যুদ্ধ রাষ্ট্রশক্তির কাজ। ব্যক্তি বা সংগঠন বা দলের অধিকার থাকে না হাতে অস্ত্র তুলে নেবার, তা করলে সেটা হত নৈরাজ্যবাদী, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যেটা ইসলামে অবৈধ।
এরপর আল্লাহর রসুল মদীনায় হিজরত করলেন, মদিনার অধিকাংশ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রসুলাল্লাহকে তাদের নেতা হিসেবে মেনে নিল। এরপর রসুলাল্লাহ রাষ্ট্রের অভিভাবক হলেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের মতোই যা যা করণীয় তা করলেন, রাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে সন্ধি, সনদ, যুদ্ধ (কেতাল) করেছেন সবই করেছেন। অর্থাৎ মক্কা থেকে হেজরত করে মদিনায় গিয়ে যেই তিনি রাষ্ট্র গঠন করলেন তখনই নীতি বদলে গেল। কারণ কোনো রাষ্ট্র কখনো ব্যক্তি বা দলের নীতিতে টিকে থাকতে পারে না। তার প্রয়োজন হয় অস্ত্রের, সৈনিকের, যুদ্ধের প্রশিক্ষণের। সুতরাং ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি গোষ্ঠি বা দলগতভাবে কোনো কেতাল অর্থাৎ সশস্ত্র যুদ্ধ নেই, আছে শুধু আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দিকে আহ্বান। ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আছে সশস্ত্র যুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অস্ত্র, যুদ্ধ ইত্যাদি যদি আইনসম্মত না হয় তবে পৃথিবীর সব দেশের সামরিক বাহিনীকেই বে-আইনী, সন্ত্রাসী বলতে হবে। কোর’আন ও হাদিসে যে কেতালের কথা আছে তা রাষ্ট্রগত। মক্কায় যেহেতু আল্লাহর রসুল অস্ত্র হাতে নেন নি, সেহেতু কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন অস্ত্র হাতে নিতে পারে না। যদি ব্যক্তি বা সংগঠন অস্ত্র হাতে নেয় সেটাই হবে সন্ত্রাস। যারা এটা করে তারা রসুলের সুন্নাহ বা আদর্শ থেকে সরে গেল।
পবিত্র কোর’আনে জিহাদ-কিতাল সম্পর্কিত শত শত আয়াত আছে। সেখানে কিতালের স্পষ্ট হুকুম আছে। কীভাবে শত্রুদেরকে কতল করতে হবে তার নির্দেশনা আছে। এমনকি এ পর্যন্ত আছে যে, অস্ত্র হালকা হোক আর ভারি হোক, বেরিয়ে পড়তে হবে। আবার হাদীসের বইতে জিহাদের উপর আলাদা অধ্যায় আছে। সিরাতের অর্ধেক জুড়ে রয়েছে বিশ্বনবীর যোদ্ধা জীবনের খুঁটিনাটি বর্ণনা। সেসব পড়লে আখেরী নবীকে একজন যোদ্ধা নবী এবং তিনি যে জাতিটি তৈরি করেছিলেন সেটাকে পুরোদস্তুর একটি যোদ্ধা জাতি বলেই প্রতিভাত হয়। চরমপন্থী জঙ্গিবাদীরা যেটা করে তা হচ্ছে, কোর’আনে বর্ণিত যুদ্ধের সেই আয়াতগুলো, হাদিসে বর্ণিত যুদ্ধ বিষয়ক রসুলের বাণীগুলো আর সিরাতে বর্ণিত যুদ্ধাভিযানের ঘটনাগুলোকেই ব্যবহার করছে নিজেদের জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেবার জন্য, কিন্তু সেগুলোর প্রেক্ষাপটকে আমলে নিচ্ছে না। ইসলামী পরিভাষায় ‘আকিদা’ বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে, যার ব্যাপারে অতীতের সকল আলেমগণ একমত হয়ে বলেছেন, আকিদা সঠিক না থাকলে ঈমানের কোনো মূল্য নেই। স্পষ্টত চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদীরা হচ্ছে আকীদাচ্যুৎ।
ইসলামের আকিদা বলতে বোঝায়- ইসলাম আল্লাহ কী লক্ষ্যে পাঠিয়েছেন, রসুল কেন পাঠিয়েছেন, কোর’আন কেন পাঠিয়েছেন, মো’মেন কে, কাফের কে, জিহাদ কী ও কেন, কেতাল কী ও কেন, কোন প্রেক্ষাপটে জিহাদ ফরদ, কার বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হয়, কার হুকুমে জিহাদ করতে হয়, জিহাদ ও কিতালের মধ্যে পার্থক্য কী, জিহাদ ঘোষণা করার অধিকার কার আছে ইত্যাদি এক কথায় সামগ্রিকভাবে ইসলাম সম্পর্কে মোটা দাগে স্পষ্ট ধারণা থাকা। এই সম্যক ধারণাকে দৃষ্টিশক্তির সাথে তুলনা করা চলে, যে দৃষ্টিশক্তি থাকলে কেউ হাতির লেজ ধরিয়ে বিশ্বাস করাতে পারে না যে, হাতি রশির মত। অন্যদিকে দৃষ্টিশক্তি যার নাই, তাকে খুব সহজেই কোনো বস্তু সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়ে ভুল কাজ করানো সম্ভব। আজকে এই সম্যক ধারণা বা আকিদা নেই বলেই ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে এখান থেকে কোর’আনের একটি আয়াত, ওখান থেকে হাদিসের একটি বাণী, সেখান থেকে সিরাতের একটি ঘটনা টেনে এনে তাকে দিয়ে যা তা করানো সম্ভব হচ্ছে।
ইসলামের বহু বিধান রয়েছে, যেমন- নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ, কিতাল ইত্যাদি। মনে করুন এই বিধানগুলোকে একেকটি ফুল। আর ইসলামকে মনে করুন সেই ফুলগুলো দিয়ে তৈরি মালা। ফুলগুলোকে যতক্ষণ না একটি সুতো দিয়ে একত্রে গেঁথে সেই সুতোটি গিঁট দেওয়া হবে ততক্ষণ কি সেটা মালা হতে পারবে? পারবে না। এই সুতোর গিঁটটাই হচ্ছে আকিদা। আমরা বিয়ের ব্যাপারে ‘আকদ’ শব্দটি ব্যবহার করি একজন পুরুষের সাথে একজন নারীর ‘সংযোগ করে দেওয়া’ বোঝাতে। অর্থাৎ যে জ্ঞান বা ধারণার মাধ্যমে ইসলামের সমস্ত বিধান, সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত রীতি-নীতি ইত্যাদি একটি সূত্রে ‘সমন্বিত’ থাকে সেটাই আকিদা। আজকে আমাদের সমাজে মসজিদ ভর্তি মানুষ নামাজ পড়ছে, লক্ষ লক্ষ লোক হজ্ব করতে যাচ্ছে, রমজান মাসে রোযা রাখছে, ঈদের দিনে উৎসব করছে, আবার কথিত জিহাদ-কিতালও করছে, কিন্তু এই বিধানগুলোর একটির সাথে আরেকটির কী সম্পর্ক, কোনটার পূর্বশর্ত কোনটা, কোনটা কার জন্য প্রযোজ্য তা অধিকাংশ মানুষই জানে না। তারা নামাজ পড়ছে কিন্তু নামাজের উদ্দেশ্য অজানা। লাখ লাখ টাকা খরচা করে হজ্ব করতে যাচ্ছে কিন্তু জানে না হজ্বের উদ্দেশ্য কী। জিহাদের নামে শরীরে বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু জানে না জিহাদের উদ্দেশ্য কী। তারা জানে না নামাজের সাথে জিহাদের সম্পর্ক কী, আবার জিহাদের সাথে তওহীদের সম্পর্ক কী। অর্থাৎ ফুল অনেক থাকলেও সেগুলো কেবলই ছিন্নবিচ্ছিন্ন ফুল। সেই ফুল কখনও মালা হয়ে উঠে নি। আর যতক্ষণ এই ফুলগুলো একত্রে গ্রন্থিত হয়ে মালা তৈরি না হয় ততক্ষণ সেটা বিশ্বনবীর ইসলাম হয় না। সেটা হয়ে যায় গোঁজামিলের ইসলাম। আর গোঁজামিলের ইসলাম আজ জঙ্গিবাদের জন্ম দিচ্ছে, কাল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম দিবে, পরশু অপ-রাজনীতির হাতিয়ার হবে- এটাই তো স্বাভাবিক।
সামগ্রিক ধারণা না থাকলে মানুষের বিশ্বাস ও আবেগ কীভাবে ভুলখাতে প্রবাহিত হতে পারে তার একটি উপমা দেই। একাত্তরে আমাদের মুক্তিবাহিনী পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। সেই যুদ্ধে তারা পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে পরাজিত করার জন্য প্রয়োজনে বোমা মেরে আমাদের দেশেরই ব্রিজ-কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেজন্য কি তাদের প্রতি আমাদের কোনো অভিযোগ আছে? নেই। কারণ আমরা জানি মুক্তিযোদ্ধারা কেন ওসব করেছিলেন। তারা সেদিন যা যা করেছেন সব আমাদেরই মুক্তির জন্য, আমাদেরই কল্যাণের জন্য। তাতে সমগ্র দেশবাসীর সমর্থন ছিল। তারা ছিলেন স্বাধীন বাংলার যুদ্ধরত সেনাবাহিনী। অর্থাৎ ঐ সময়ের প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের রাজনীতিক সম্পর্ক, বাঙালি জাতির প্রতি হওয়া অন্যায় ও তার ফলে স্বাধীনতা ঘোষণা, পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ও বাঙালির প্রতিরোধ- এই সমস্ত ঘটনার একটির সাথে অপরটির সম্পর্ক অর্থাৎ সামগ্রিক ধারণা আমাদের জানা আছে বলেই আমরা গর্বভরে বলতে পারছি- একাত্তরে আমাদের মুক্তিবাহিনী অন্যায় করে নাই, যদিও তারা অনেক স্থাপনা বিধ্বস্ত করেছেন, অনেক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছেন, মানুষ হত্যা অবধি করেছেন। কিন্তু আজকে যদি এই স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো নাগরিক হঠাৎ একটি বোম মেরে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে বলে- ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা! আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করছি’ তাকে কী বলবেন? সেও হয়ত কিছু অন্যায়, অবিচারের কথা শুনিয়ে বলবে- পাকিস্তানিরা যেভাবে আমাদের সাথে অন্যায় করত, অমুক সরকার সেভাবেই জনগণের সাথে অন্যায় করছে, আমাদেরকে শোষণ করছে, পাকিস্তানিদের মতই এদেশের সম্পদ পাচার করে বিদেশে জমা করছে ইত্যাদি। কিন্তু এজন্য কি তার বোমা মারা যায়েজ হয়ে যায়? সেও রেফারেন্স হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রামাণ্য ইতিহাস বইয়ের ভেতর থেকে কোনো একজন মুক্তিযোদ্ধার কোনো একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা টেনে বলবে- এই যে, দ্যাখো অমুক মুক্তিযোদ্ধা এত তারিখে এই স্থানে এইভাবেই বোমা মেরে অমুক ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন, সুতরাং তিনি যদি অন্যায় না করেন তাহলে আমিও অন্যায় করি নাই। আপনি কি তার যুক্তি মেনে নিবেন? মানবেন না। কারণ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার সামগ্রিক ধারণা আছে। আপনার আকিদা পরিষ্কার।
অন্ধের হাতি দেখার ঘটনা সবাই জানেন। একজন অন্ধ হাতির পেটটা ধরে মনে করল হাতিটা একটি প্রাচীরের মতো। আরেকজন অন্ধ শুধু পা ধরে মনে করল হাতিটা একটি থামের মতো। আরেকজন হাতির শুঁড় ধরে মনে করল হাতিটা বুঝি অজগরের মতো। আরেকজন হাতির কান ধরে মনে করল হাতি একটি কুলার মতো। তারা সবাই হাত দিয়ে হাতিকে ধরে নিশ্চিত হয়েই তাদের অভিমত ব্যক্ত করল কিন্তু হাতি কি আদৌ তাদের বর্ণনার অনুরূপ? না। তাদেরকে যদি দৃষ্টিদান করা যায় তাহলেই তারা পূর্ণাঙ্গ হাতিটিকে একসাথে দেখতে পারবে এবং নিজেদের ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হতে পারবে।
সুতরাং এখন একটাই করণীয় আপামর সাধারণ জনতাকে ইসলাম সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা বা আকিদা সঠিক করে দেওয়া যেন তারা কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ভুল পথে না যায়। যেন তারা বুঝতে পারে যে, মানুষের ক্ষতি হয় এমন কোনো কথা কাজ বা চিন্তা সবই গোনাহের কাজ। আর মানুষের তথা মানবজাতির উপকার হয় বা কল্যাণ হয় এমন কথা কাজ বা চিন্তা সবই সওয়াবের কাজ। তাহলে একটি কাজের আগেই তারা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করে সঠিক পথ ও ভুল পথ নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারবে। তারা এটাও বুঝতে সক্ষম হবে যে, কোনটা ইসলামের কাজ আর কোনটা ইসলামের কাজ নয়, ইসলামের কোন কাজটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বা মুখ্য আর কোন কাজটি গৌণ বা কম গুরুত্বপূর্ণ।  লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...