হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

গণতন্ত্র নিজে কতটা গণতান্ত্রিক?

আসাদ আলী:

গণতন্ত্র বর্তমান দুনিয়ার একটি বহুল আলোচিত মতবাদ। দুনিয়ার বিপুল সংখ্যক মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি গভীরভাবে অনুগত। তাদের মতে, ‘গণতন্ত্র হলো একটি আদর্শ শাসনব্যবস্থা; বর্তমান পৃথিবীতে কেবল এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই মানুষ অনাবিল সুখ ও শান্তি অর্জন করতে পারে। মানুষের প্রকৃত অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত হয়ে থাকে একমাত্র গণতন্ত্রেই। ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকেন্দ্রীক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সাধারণ মানুষের অসীম ভোগান্তি থেকে গণতন্ত্র মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। ক্ষমতাকে সে বণ্টন করে দিয়েছে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাঝে।’ কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এর যৌক্তিকতা কতটুকু? গণতান্ত্রিক দেশুগলোর মানুষ কি সত্যই সুখের দরিয়ায় নিমজ্জিত হয়ে আছে? প্রশ্নটি গণতন্ত্রপ্রেমীরা আদৌ খতিয়ে দেখেন না। তারা দেখেন না যে- গণতন্ত্রের নামে দুনিয়ায় যতই সোরগোল উঠছে ততই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, দৈন্যতা বাড়ছে। এমনকি দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের হোতারাই মানুষকে দুর্দশাতে নিক্ষেপ করার প্রধান ভূমিকা পালন করছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলতে যে কথাটি বর্তমান সুধী সমাজে দারুনভাবে প্রচলিত আছে গণতন্ত্র তার কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে আর ভবিষ্যতেই বা পারার সম্ভাবনা কতটুকু সেটাও তারা খতিয়ে দেখেন না।

গণতন্ত্র ইউরোপের সৃষ্টি। প্রাকগণতান্ত্রিক যুগে পৃথিবীর বহু অঞ্চলের মত ইউরোপেও রাজতন্ত্র চালু ছিল। তারও আগে ছিল সামন্ততন্ত্র। রাজতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্র উভয় যুগেই যে বিষয়টি মানুষের অন্যায়-যুলুমের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দেখা দিয়েছে তাহলো ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ। সামন্ততন্ত্রে একটি ছোট এলাকার যাবতীয় ভূ-সম্পত্তির মালিক ছিলেন মাত্র একজন। তিনিই ছিলেন ঐ এলাকার সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। অনেকটা আমাদের উপমহাদেশের জমিদার প্রথার মত। সাধারণ মানুষ সেখানে বিবেচিত হত প্রজা বা প্রকারান্তরে রাজার দাস হিসেবে। অতঃপর রাজতন্ত্রেও ক্ষমতার মালিক থাকতো একজন রাজা বা বাদশাহ। তার মুখের কথাই ছিল আইন। তার একটিমাত্র আদেশে শত-সহস্র সাধারণ জনতার কর্তিত মুণ্ড রাজপথে গড়াগড়ি খেত। অর্থাৎ সামন্ততন্ত্র বা রাজতন্ত্র উভয় শাসনেই বিরাট প্রজাসাধারণের সামনে যে বিষয়টি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাহলো ক্ষমতা একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া। এই অন্যায়-যুলুম থেকে বাঁচার আশাতেই তারা আশ্রয় নেয় গণতন্ত্রের ছায়াতলে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপে গণতন্ত্র একটি গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়। তারা গণতন্ত্রের ক্ষমতা বণ্টনের নীতি কথায় আশ্বস্ত হয়ে পরম শ্রদ্ধাভরে এটাকে গ্রহণ করে। পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন পট-পরিবর্তন এবং উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাঁকি পৃথিবীও গণতন্ত্রের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে বা করতে বাধ্য হয়।
এখন আসা যাক- যে অন্যায় থেকে বাঁচার আশায় ইউরোপসহ বাকি পৃথিবী গণতন্ত্রকে পরম শ্রদ্ধাভরে কাছে টেনে নিয়েছিল সেই আশা কতটুকু পূরণ হয়েছে এই বিষয়ে। কার্যক্ষেত্রে গণতন্ত্র সে আশা আজ পর্যন্ত পূরণ করতে পারে নি। শুধু যে পারে নি তাই নয়, উপরন্তু সামন্ততন্ত্র বা রাজতন্ত্রের মত গণতন্ত্রেও ক্ষমতার একক মালিকানাই দৃষ্ট হচ্ছে। কার্যত সার্বভৌমত্ব ন্যস্ত থাকছে একটি দলের এবং আরো গভীরে গেলে একটি ব্যক্তির হাতে। গণতন্ত্রের প্রকারভেদ অনুযায়ী তিনি হতে পারেন প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতি। এই প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিই হচ্ছেন গণতান্ত্রিক সিস্টেমের রাজা, বাদশাহ ও জমিদার। এই রাজা-বাদশাহরা তাদের নিজেদের ইচ্ছামত রাষ্ট্র চালান, রাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন, আইন-প্রণয়ন করেন, জনগণের কর ধার্য করেন, বৈদেশিক ঋণ নেন, আন্তর্জাতিক চুক্তি করেন ইত্যাদি। তাদের কোন কাজে অধিকাংশ জনতার সমর্থন না থাকলেও সে কাজ থেমে থাকে না। আবার দেখা যায়- কোন একটি কাজ দেশের অধিকাংশ মানুষ চাইলেও দেশের গণতান্ত্রিক সরকার সে কাজে হাত বাড়ায় না, সেটা করতে বাধ্য থাকে না। বৃহত্তর জনগোষ্ঠির পরিচালিত শাসন বলা হলেও এই পদ্ধতিতে সাধারণত দেশের গুটিকতক লোকই দেশের শাসনকার্য চালায় আর তাদের নেতার হাতেই থাকে সার্বভৌম ক্ষমতা। রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে দেশের অধিকাংশ জনতার মতামতের প্রতিফলন ঘটাও সম্ভব হয় না। উদাহরণ হিসেবে যে কোন দেশের একটি সংসদ নির্বাচনকে নেয়া যাক।
ধরা যাক, একটি নির্বাচনী এলাকায় চার জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। তারমধ্যে একজন প্রার্থী ভোট পেল ১০ হাজার, একজন পেল ১২ হাজার, একজন পেল ১৪ হাজার আর একজন পেল ১৫ হাজার। যে ব্যক্তি ১৫ হাজার ভোট পেল সে নির্বাচিত হলো। আর বাহিরে থাকল ৩৬ হাজার ভোট। তাহলে দেখা গেল যে এই ৩৬ হাজার ভোটারের ভোট মাঠে মারা গেল, সেগুলো কোন কাজে আসলো না। এই অধিক সংখ্যক ভোটারের ইচ্ছা এবং তাদের মতামত রাষ্ট্রের কাজে কোন প্রভাব ফেলতে পারল না। অথচ অল্প সংখ্যক ভোট পেয়ে একজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে গেল এবং রাষ্ট্রীয় কাজে অংশ নিল। ফলে ১৫ হাজার মানুষের মতামত যদি বাকি ৩৬ হাজার মানুষের মতের বিপরীতও হয়ে থাকে তথাপি স্বাভাবিকভাবেই ঐ নির্বাচিত ব্যক্তি বাস্তবায়ন করবে ঐ ১৫ হাজারের মতামত। এভাবে স্বল্প সংখ্যক ভোট পেয়েও সাংসদরা সংসদে আসে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো পার্লামেন্টে সদস্য সংখ্যা ৩০০ জন। এই ৩০০ জনের মধ্যে ১৫১ জন যাকে সমর্থন করে সে সরকার গঠন করে। এই ১৫১ জন লোকের প্রাপ্ত ভোট যে বাকি ১৪৯ জন সদস্যের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে বেশি হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেশের অধিকাংশ মানুষের মতের বিরুদ্ধে হলেও গণতন্ত্রের ভোটের জটিলতার শিকার হয়ে একটি কম জনসমর্থনপ্রাপ্ত দল সরকার গঠন করে। আবার ধরা যাক, ১৬০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে একটি সরকার গঠন হল। এই ১৬০ জন সদস্যই কিন্তু আবার মন্ত্রী হতে পারে না। অল্প কিছু লোকমাত্রই সে সুযোগ পায়। আর এই মন্ত্রীদের হাতেই থাকে দেশের সর্বময় ক্ষমতা। কাজেই মন্ত্রীসভার বাইরের সদস্যদের মতামত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অকার্যকর থেকে যায়। তাদের সমর্থনে যে বৃহৎ জনগোষ্ঠি ভোট দিয়েছিল তাদের আশা-আকাক্সক্ষাও অপূরণীয় হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে বিচার করলে দেখা যায়- গণতন্ত্রে অল্প সংখ্যক লোকই শাসনক্ষমতা লাভ করে এবং দেশ শাসন করে। অতি অল্প কিছু লোক দ্বারাই দেশ পরিচালিত হয়। আর যারা দেশ পরিচালনা করে তারা বৃহত্তর জনসাধারণের সমর্থনেই যে ক্ষমতায় রয়েছে সে কথা বলারও কোন বাস্তব ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ, গণতন্ত্র একটি বাস্তব প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। তদুপরি গণতন্ত্রের প্রতারণা এক স্পষ্ট ধোঁকায় রূপ লাভ করে যখন গণতন্ত্রকে মেজরিটি লোকের শাসন বলে অভিহিত করা হয়, মানুষকে বোঝানো হয়। এসব কিছু বিবেচনায় আনলে এ কথা বলাই যায় যে আসলে গণতন্ত্র নিজেই গণতান্ত্রিক নয়।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...