হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

খ্যাতি ও স্বার্থপ্রত্যাশী আলেমদের পরিণাম

রিয়াদুল হাসান
আল্লাহর দীন বিকৃত হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে দীনের বিষয়বস্তু নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি করা। এই কাজটি সাধারণ মুসলিমরা করেন না, এটা করেন যাদের দীন সম্পর্কে জ্ঞান আছে অর্থাৎ কথিত ধর্মজ্ঞানীরা। তাদের দীন সংক্রান্ত মতভেদের পরিণামে জাতিও তাদের অনুসরণ করে বহু ভাগে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেছে এবং এখনও নতুন নতুন মতবাদে দীক্ষা নিয়ে এক উম্মাহকে আরো টুকরো টুকরো করে ফেলছে। সামান্য তারাবির সালাত ৮ রাকাত না ২০ রাকাত, নবী নূরের তৈরি না মাটির তৈরি এসব বিষয় নিয়ে তারা শত শত বছর বিতর্ক করে যাচ্ছেন।
একজন জীবিত মানুষকে যখন দুইটি টুকরো করা হয় সে আর জীবিত থাকে না, তেমনি আজ ১৬০ কোটি উম্মতে মোহাম্মদীর দাবিদার জনগোষ্ঠী অর্ধপৃথিবী জুড়ে বিরাট লাশের মতো পড়ে আছে। হাজার হাজার ভাগে তারা খণ্ডবিখণ্ড। এই কাজটি করেছেন জাতির কথিত আলেম সাহেবরা, ফেরকা সৃষ্টিকারী ইমামগণ, দীনের অতি বিশ্লেষণকারী মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুজতাহিদ, মুফতিগণ, ভারসাম্যহীন সুফিবাদী পীর, মাশায়েখ, বুজুর্গানে দীনেরা। তারা তাদের অনুসারী তৈরি করেছেন, রসুলের (সা.) হাতে গড়া জাতি ছিন্নভিন্ন হয়ে প্রাণহীন লাশে পরিণত হয়েছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামের প্রতিটি আমলের উদ্দেশ্য হবে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো আমল করা হলে সেটা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না, সেটার বিনিময়ও আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে না। উপরন্তু সেই লোক দেখানো আমল তার জাহান্নামের কারণ হবে। রসুলাল্লাহ (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন এমন একজন ‘আলেমকে’ উপস্থিত করা হবে যে দীনের জ্ঞান অর্জন করেছে এবং মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছে এবং কোর’আন পাঠ করেছে। অতঃপর তাকে আল্লাহর নেয়ামতসমূহ স্মরণ করানো হবে। সেও তা স্বীকার করবে।
আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন: আমার দেয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ?
সে বলবে: আমি আপনার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে দীনের জ্ঞান অর্জন করেছি, অন্যকে তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্যে কোর’আন পাঠ করেছি।
আল্লাহ বলবেন: তুমি মিথ্যা বলছ; বরং তুমি এই জন্যে বিদ্যা শিক্ষা করেছিলে যাতে করে মানুষ তোমাকে আলেম বলে। আর এই জন্যে কোর’আন পাঠ করেছিলে যাতে লোকেরা তোমাকে কারী বলে। পৃথিবীতে তোমাকে এই সব বলা হয়ে গেছে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেয়া হবে। অতঃপর নাক ও মুখের উপর উপুড় করে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (হাদিস: সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ।)
যেখানে শুধু আলেম বা কারী বলে পরিচিত হওয়ার বাসনা থাকার দরুন তার সব আমল ব্যর্থ সেখানে অর্থ রোজগারের নিয়তে আলেম দাবিদার ব্যক্তির প্রতি কী আচরণ করা হবে সেটাও আল্লাহর রসুল বলে গেছেন, “যে ব্যক্তি এমন কোনো জ্ঞান অর্জন করল, যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, কিন্তু তা সে কেবল পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে অর্জন করল, কেয়ামতের দিন সে ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধ পর্যন্ত পাবে না।” (হাদিস: আবু হোরায়রাহ রা. থেকে আবু দাউদ।)
বিদায় হজ্বের দিন আল্লাহর রসুল বলেছিলেন, “আজ যারা এই সমাবেশে উপস্থিত নেই তাদের কাছে যারা উপস্থিত রয়েছ তারা আমার এই কথাগুলো পৌঁছে দেবে।” সত্য প্রচারের এই যে দায়বদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতা উম্মাহর উপর তাদের নেতা, আল্লাহর শেষ রসুল কর্তৃক অর্পিত হলো সেই দায়িত্ব কি উম্মাহ টাকার বিনিময়ে পালন করবে? এই সত্যের শিক্ষা প্রদানের সাথে কি অর্থের বা স্বার্থের কোনো সংযোগ থাকতে পারে? আল্লাহর রসুল যা কিছু করেছেন তা কি তিনি অর্থের বিনিময়ে করেছেন? নাউজুবিল্লাহ। তিনি নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর নির্দেশে অতিবাহিত করেছেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ তাঁকে এর বিনিময়ে কোনো আজরিন, র্খাজান, মা’লান অর্থাৎ মজুরি, সম্পদ, বিনিময় (ঢ়ধুসবহঃ, বিধষঃয, ৎবধিৎফ) গ্রহণ না করার জন্য অন্তত ছয়টি আয়াতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেছেন,
এবং তুমি তাদের নিকট কোনো মজুরি দাবি করো না। এই বাণী তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র (সুরা ইউসুফ ১০৪)।
বল! আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের দলভুক্ত নই (সুরা সা’দ ৮৬)।
বল! আমি এর (দীনের) বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসা ও আত্মীয়তাজনিত সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনো মজুরি চাই না (সুরা শুরা ২৩)।
(হে মোহাম্মদ!) তুমি কি তাদের নিকট কোনো মজুরি চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই তো শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ রেযেকদাতা (সুরা মো’মেনুন ৭২)।
তবে কি তুমি তাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাচ্ছো যা ওরা একটি দুর্বহ বোঝা মনে করে? (সুরা তুর ৪০)
তাঁদেরকেই (নবীদেরকেই) আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথ অনুসরণ কর; বল! এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোনো মজুরি চাই না (সুরা আনআম ৯০)।
শেষোক্ত আয়াতটিতে আল্লাহ পূর্বের সমস্ত নবী-রসুলদের কথা উল্লেখ করে তাঁর শেষ রসুলকে (সা.) নির্দেশ দিচ্ছেন পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করতে। সেই পথটি কী? সেটা হচ্ছে বিনা মজুরিতে আল্লাহর দীনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সমসাময়িক বিকৃত ধর্মের ধারক বাহকদের ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নেওয়ার দরুন আল্লাহর নবী-রসুলগণ ধর্মব্যবসায়ী আলেম পুরোহিত গোষ্ঠীর দ্বারা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। নবী-রসুলরা তাদের এই ধর্মব্যবসাকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন, যার ফলে তারা রুজি রোজগার বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি সম্মান ও কর্তৃত্ব খোয়ানোর আশঙ্কায় নবী-রসুলদের বিরুদ্ধে জনগণ ও শাসক শ্রেণিকে খেপিয়ে তুলেছেন। নবী-রসুলগণ সকলেই তাদের জাতির উদ্দেশ্যে একটি সাধারণ ঘোষণা দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় রয়েছে আল্লাহর কাছে। এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিনি যা তাদের সামনে উপস্থাপন করছেন তা নির্ভেজাল সত্য, হক্, এতে মিথ্যার কোনো মিশ্রণ নেই। কারণ প্রতিটি মিথ্যাই হয় উদ্দেশ্য-প্রণোদিত, তাতে মানুষের কোনো না কোনো পার্থিবস্বার্থ জড়িত থাকে। নবী-রসুলগণ যে কোনো পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছেন না সেটা সুস্পষ্ট করার জন্যই এ কথাটি বলতেন। বিনিময় গ্রহণ না করা তাঁদের সত্যতার, হাকিকতের বড় একটি নির্দেশক।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...