হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কেমন ছিলেন সাহাবীগণ- মুসয়াব ইবনে উমায়র (রা.)

34(প্রথম খণ্ড) নাম মুসয়াব (রা.), তাঁর কুনিয়াত হলো আবু মুহাম্মদ। ইসলাম গ্রহণের পর লকব বা উপাধি হয় মুসয়াব আল খায়ের। পিতা উমায়র এবং মাতা খুনাস বিনতে মালিক। পিতা মাতার পরম আদরে এবং ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত মক্কার অন্যতম সুদর্শন যুবক ছিলেন তিনি। মা সম্পদশালী হওয়ার কারণে অত্যন্ত ভোগ বিলাসের মধ্যে তাকে প্রতিপালন করেন। তখনকার যুগে মক্কার যত রকমের চমৎকার পোশাক ও উৎকৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত, তার সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রসুলালাহর (দ.) সামনে কোনভাবে তাঁর প্রসঙ্গ উঠলে বলতেন; “মক্কায় মুসয়াবের (রা.) চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোশাকধারী আর কেউ ছিল না”। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ছিলেন মক্কার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যাবহারকারী।
সৌন্দর্য, সুরুচি ও সৎ স্বভাবের সাথে তাঁর অন্তরও ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। তওহীদের আহ্বান পৌছামাত্রই তিনি সত্য মিথ্যার পার্থক্য অনুধাবন করতে পারলেন। এটা সেই সময়ের কথা যখন রসুল (দ.) গোপনে আরকাম (রা.) এর বাড়িতে অবস্থান করে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন ও তাঁর উপর বিশ্বাস আনয়নকারীদের জন্য মক্কার মাটি সঙ্কীর্ণ হয়ে উঠেছিল। মক্কার অলিতে-গলিতে, কুরাইশদের আড্ডায়, পরামর্শ সভায় তখন একই আলোচনা- (মোহাম্মদ) আল আমিন (দ.) ও তাঁর নতুন দীন ইসলাম। কুরাইশদের এসব আলোচনা সভায় উপস্থিত থেকে মুসয়াব ইবনে উমায়র (রা.) অত্যন্ত মনযোগ সহকারে শ্রবণ করতেন। কুরাইশদের অধিকাংশ আলোচনা সভার শোভা এবং মধ্যমণি হিসেবে তিনি উপস্থিত থাকতেন। তাদের প্রতিটি বৈঠকে সকলের কাম্য হতো তাঁর উপস্থিতি। তীক্ষè মেধা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এসমস্ত গুণাবলির সাথে যুক্ত হয়েছিল দূরদৃষ্টি সম্পন্ন উদার হৃদয়ের। ফলে রসুলের (দ.) নতুন দীনের আহবান ও এতে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের কর্মকাণ্ডের উপর তিনি গভীর পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ব্যাপারটা তাঁর হৃদয়ের গভীরে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি বিষয়টা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করে অবশেষে এক সন্ধ্যায় বিশ্বাসীদের মিলনস্থল আরকাম ইবনে আবিল আরকামের বাড়িতে মোহাম্মদ (দ.) এর নিকট উপস্থিত হন।
মুসয়াব ইবনে উমায়র (রা.) এসে বসতে না বসতেই কোরআনের কিছু আয়াত নাজিল হলো। রসুলালাহর (দ.) মুখ থেকে সেই আয়াত সকলের মতো মুসয়াবও (রা.) মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলেন। এরপর তিনি ঐ দিনই তওহীদ ভিত্তিক কলেমার ঘোষণা দিয়ে বিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যান। রসুল (দ.) তাঁর পবিত্র হস্ত দিয়ে মুসয়াবের বুকের উপর বুলিয়ে দিয়ে আলাহর কাছে মুসয়াবের অন্তরের স্থিতিশীলতার জন্য দোয়া করে দিলেন।
মুসয়াবের মা খুনাস বিনতে মালিক ছিলেন গম্ভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। মুসয়াব তাকে যমের মতো ভয় করতেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ধরাপৃষ্ঠে একমাত্র তাঁর মাকেই কিছুটা ভয় করতেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন আপাতত কিছুদিন তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর মায়ের কাছে গোপন রাখার। এভাবে তিনি গোপনে দারুল আরকামে রসুলালাহর (দ:) দরবারে যাতায়াত করতে থাকলেন।
একদিন দারুল আরকামে যাওয়ার পথে উসমান ইবনে তালহা তাঁকে দেখে ফেলল। আরেকদিন তিনি রসুলালহর (দ:) দেখিয়ে দেয়া তরিকায় সালাহ কায়েমরত অবস্থায় এই উসমানই তাঁকে দেখে ফেলে। ফলে দ্রুতগতিতে খবরটি মক্কার অলিতে গলিতে প্রচার হয়ে গেল। খবরটা তাঁর মায়ের কানেও পৌছল।
মুসয়াবকে (রা.) তাঁর মা এবং গোত্রের নেতৃবৃন্দের সামনে কাঠগড়ায় দাড় করানো হলো। তিনি অত্যন্ত স্থির বিশ্বাসে তাদেরকে পাঠ করে শুনাতে লাগলেন কুরআনের সেই অমীয় বাণী যার উপর তিনি ঈমান এনেছেন। মা তাঁর গালে চড় মেরে চুপ করিয়ে দিতে চাইলেন। বকাঝকা, মারপিট চলল। তারপর তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখা হলো।
তিনি বন্দী অবস্থায় সময় কাটাতে থাকলেন। রাত্রিদিন চব্বিশ ঘন্টা তাঁকে পাহারায় রাখা হলো। এর মধ্যে তিনি খবর পেলেন, কিছু মু’মিন হাবশায় হেজরত করে চলে যাবার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই দলটির সাথে হাবশায় চলে গেলেন।
কয়েক মাস হাবশায় থাকার পর তিনি মক্কায় ফেরত আসলেন। তারপর রসুলালাহর (দ:) নির্দেশে আরেকটি দলকে সঙ্গে করে হাবশায় চলে যান। কিন্তু মুসয়াব উপলব্ধি করছিলেন, তিনি মক্কায় বা হাবশায় যেখানেই থাকুন না কেন, জীবন তার নতুন রূপ ধারণ করেছে। তাঁর কাছে একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ মুহাম্মদ (দ:) এবং একমাত্র কাম্য মহাপ্রভূ আলাহর সন্তুষ্টি।
তাঁর মা তাঁকে নতুন দীন থেকে ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে ভরণপোষণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যে ব্যক্তি তাদের দেব-দেবীকে ছেড়ে দিয়েছে, তাদের গালাগাল করে, তা সে নিজের পেটের ছেলেই হোক না কেন, তাকে সে কোন মতেই খেতে দিতে পারে না।
মুসয়াব (রা.) হাবশা থেকে ফিরে আসার পর তাঁর মা আবারো তাঁকে বন্দী করতে চাইলেন। তিনি মায়ের মুখের উপর কসম খেয়ে বললেন ঃ “যদি তুমি এমনটি কর, তবে তুমি এবং যারা তোমার এ কাজে সহায়তা করবে তাদের সবাইকে আমি হত্যা করব।” মা তার এই ছেলের চরিত্র জানতেন, তাই কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে বিদায় দিলেন।
বিদায় মুহুর্তে মা যেমন কুফরীর উপর ছেলে তেমন ঈমানের উপর অটল। প্রাণ-প্রিয় ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে দিতে মা বলছে; “ তোমার যেখানে খুশী যাও, আমাকে আর মা বলে ডেকো না”। ছেলে একটু মায়ের দিকে এগিয়ে বললেন; “মা আমি আপনাকে ভালো কথা বলছি, আপনি একবার শুধু বলুন! ‘আলাহ ছাড়া কোন এলাহ নাই’। মা রেগে গিয়ে নক্ষত্ররাজীর নামে কসম খেয়ে বললেন; “আমি তোমার দীন গ্রহণ করব না, তোমার দ্বীন গ্রহণ করা হলে আমার মতামত ও বুদ্ধি বিবেক দুর্বল বলে মনে করা হবে”।
এভাবে কুরাইশদের এক আদুরে ও বিলাসী সন্তান মুসয়াব (রা:) বাড়ি ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন। এখন তিনি শতচ্ছিন্ন তালিযুক্ত পোশাক পরেন, একদিন খাবার জুটলে অন্যদিন জুটে না। মদিনায় হিজরতের পর কোন একদিন সাহাবীদের একটি দল রসুলালাহর (দ:) পাশে বসেছিলেন। এমন সময় তাদের পাশ দিয়ে মুসয়াব (রা:) যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখেই বৈঠকে উপস্থিত সকলের মধ্যে বিষাদময় ভাবের উদ্রেক হলো। মনোঃকষ্টে তাদের কারো কারো চোখে পানি নেমে এলো। কারণ, মুসয়াবের গায়ে তখন শত তালি দেয়া জীর্ণ শীর্ণ একটি চামড়ার টুকরা। তাতে অসহনীয় দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। তাঁদের সকলের মনে তখন মুসয়াবের (রা:) ইসলাম পূর্ব জীবনের ছবি ভেসে উঠল। তখনকার পরিচ্ছদ হতো বাগিচার ফুলের মতো কোমল চিত্তাকর্ষক ও সুগন্ধিময়। এ দৃশ্য দেখে রসুল বললেন; “আমি মক্কায় এই মুসয়াবকেই দেখেছি পিতামাতার সবচেয়ে আদরের পুত্র হিসেবে। তার মতো স্বচ্ছল পরিবারের বিলাসী যুবক মক্কায় আর একজনও ছিল না। আলাহ ও তাঁর রসুলকে ভালোবেসে সমস্ত কিছু সে ত্যাগ করেছে।”
হিজরতের কয়েক মাস পূর্বে তিনি হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে আসেন। তখন হজ্জের মওসুমে মদিনা থেকে কিছু লোক মক্কায় এসে রসুলের (দ:) সাথে গোপনে আকাবা নামক স্থানে সাক্ষাৎ করেন এবং কলেমার উপর ঈমান এনে বাইয়্যাত করেন। এই ঘটনাকে আকাবার প্রথম শপথ বলা হয়। হজ্জ শেষে তাঁরা মদিনায় ফিরে গেলেন। তাদেরকে দ্বীনি শিক্ষা এবং অন্যদের কাছে দীনের বালাগ পৌঁছানোর জন্য ও মদিনাতে হিজরতের উপযোগী ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য রসুল মদিনায় মুবালেগ এবং মুয়ালেম হিসেবে দূত প্রেরণ করতে চাইলেন।
মক্কায় তখন মুসয়াবের থেকেও বয়সে ও মর্যাদায় উর্ধ্বতন আরো সাহাবী ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য রসুল তাঁকেই নির্বাচন করেন। মুসয়াব (রা:) তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা, বাস্তব বুদ্ধি ও মহৎ চরিত্রের সাহায্যে মদিনাবাসীর হৃদয় জয় করেন। ফলে খুব দ্রুতগতিতে মুসয়াব তাঁর কাক্সিক্ষত লক্ষ্য হাসিল করেন।
মুসয়াব (রা:) মদিনায় এলেন, মদিনায় পৌঁছে আসয়াদ ইবনে যারারার (রা:) অতিথি হলেন। তাঁরা দুজন মদিনার বিভিন্ন গোত্রে, বিভিন্ন বাড়িতে এবং সভায় আলাহর সার্বভৌমত্বের প্রতি মানুষকে আহ্বান করতে থাকলেন। তাঁরা তাঁদের এই কাজে সমস্ত বাধা বিপত্তি সবর ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে জয় করলেন। মুসয়াব মদিনায় আগমনের পূর্বে মাত্র বারজন লোক আকাবায় এসে দীন গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি মদিনায় আগমনের কিছু দিনের মধ্যেই বহু মদিনাবাসী তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীন গ্রহণ করলেন। পরবর্তী হজ্জ মওসুমে ইয়াসরেবের বাহাত্তর জনের একটি প্রতিনিধিদল মুসয়াবের নেতৃত্বে আবার আকাবায় রসুলালাহর সাথে মিলিত হয়ে দীনের বাইয়্যাত নেন। একে আকাবার দ্বিতীয় শপথ বলা হয়।
একদিন তিনি মদিনার কিছু লোকের কাছে বসে তওহীদের বালাগ দিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ বনী আবদিল আশহালের নেতা উসাইদ ইবনে হুদাইর সশস্ত্র অবস্থায় অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উপস্থিত হলেন। তার রাগের কারণ মুহাম্মদের (দ:) দূত তাদের পিতৃধর্মের বিরুদ্ধে লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তুলছে, এমনকি সে তাদের উপাস্য দেব দেবীদেরকেও গালাগাল করছে। সুতরাং এই লোকটাকে দেখে নেওয়ার উদ্দেশ্যে উসাইদের এই আগমন। উত্তেজিত উসাইদকে দেখে মদিনার অন্যান্য নতুন দীন গ্রহণকারী সাহাবীরা কিছুটা ভীত হলেন। কিন্তু মুসয়াব (রা:) ভয় না পেয়ে উসাইদকে সহাস্যে স্বাগত জানালেন। উসাইদ তখন তাঁকে এবং আসয়াদ ইবনে যারারাকে (রা:) লক্ষ্য করে বলছেন; “তোমরা আমাদের এলাকায় এসে এভাবে আমাদের লোকদের বোকা বানাচ্ছ কেন? যদি তোমদের মরার শখ না থাকে তাহলে এখনি আমাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে যাও।
হাসতে হাসতে মুসয়াব (রা:) তাঁকে বললেন; “আগে তো বসে আমার কথা শুনুন! তারপর ভালো লাগলে মানবেন, না লাগলে আমরা চলে যাব।” উসাইদ ছিলেন একজন বুদ্ধিমান দলনেতা। মুসয়াবের প্রস্তাব তাঁর মনঃপুত হলো। শুনতে তো আর কোন আপত্তি নেই। তাই তিনি ধৈর্য সহকারে মুসয়াবের কথা শুনলেন।
মুসয়াব তাকে তওহীদের মর্মবাণী শোনালেন এবং পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করে শোনালেন। ধীরে ধীরে উসাইদের মনোভাব পরিবর্তিত হতে লাগল। মুসয়াবের বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই উসাইদ বলে উঠলেন; “এ তো খুবই সত্য এবং চমৎকার কথা, তোমাদের দীনে প্রবেশ করতে হলে কি করতে হয়?” মুসয়াব (রা:) বললেন, “পবিত্র শরীর ও পোশাক নিয়ে ‘লা ইলাহা ইলালাহ্র’ ঘোষণা দিতে হয়।” (চলবে)

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...