হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কেবল শক্তি প্রয়োগে অপরাধ কতটা দূর করা সম্ভব?

রাকীব আল হাসান
নৌকাকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করে এর মাঝি ঠিক তেমনি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে তার আত্মা। কলুষিত আত্মা তাকে অন্যায়ের দিকে ধাবিত করে, তাকে দিয়ে অপরাধ করায় আর পবিত্র আত্মা তাকে ন্যায়ের দিকে ধাবিত করে। কোনো অপরাধীর সংশোধন মানে হলো তার আত্মার সংশোধন, চরিত্রের সংশোধন। আইন, বিচার ও শাসনব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হওয়া উচিত অপরাধীদের আত্মার সংশোধন তথা চরিত্রের সংশোধনের মাধ্যমে তাদের পরবর্তী অপরাধ থেকে বিরত রাখা আর শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেন শিক্ষিত প্রতিটি মানুষ আত্মিকভাবে এমন সংশোধিত, পবিত্র হবে যে, সে এমনিতেই যাবতীয় অন্যায় থেকে দূরে থাকবে, অন্যকেও অন্যায় কাজ থেকে বিরত করার চেষ্টা করবে।
প্রকৃত ইসলাম মানুষের আত্মার এমন পরিবর্তন করেছিল যে, যারা চরম অন্যায়-অবিচার, অনৈক্য-হানাহানিতে লিপ্ত ছিল তারাই অর্ধ পৃথিবীতে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল যেখানে অপরাধ প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, যারা রিপুর তাড়নায় কোনো অপরাধ করেও ফেলত তারা নিজে থেকেই আদালতে গিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি কামনা করত আত্মিক পবিত্রতা অর্জনের জন্য। তবু অল্প কিছু অপরাধপ্রবণ মানুষ থাকবে যাদের আত্মায় সত্য প্রবেশ করবে না, অন্যায়-অপরাধ করা বাদ দিবে না তাদের জন্য প্রয়োজন শাস্তির ব্যবস্থা, তারা শাস্তির ভয়ে অপরাধ থেকে বিরত থাকবে। তাই প্রকৃত ইসলামে একদিকে যেমন আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে অপরাধ থেকে মানুষকে দূরে রাখার প্রক্রিয়া রয়েছে তেমনি অপরাধ করে ফেললে তার শাস্তির ব্যবস্থা তথা দণ্ডবিধিও রয়েছে। অর্থাৎ এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা।
মানবরচিত জীবনব্যবস্থাগুলো আত্মাহীন, ধর্মহীন, জড় ও বস্তুবাদী। তাই মানুষের আত্মাকে নিয়ন্ত্রণের বদলে তা কেবল আইন দিয়ে, শক্তি প্রয়োগ করে মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে চায়। সমাজে অপরাধ বেড়ে গেলে শক্তি প্রয়োগের মাত্রা বাড়ানো হয়। অপরাধ থেকে দূরে রাখার জন্য নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে বরং বিভিন্নভাবে অপরাধ করবার জন্যই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করা হয়। যেমন- ধর্ষণ একটা অপরাধ, এটাকে বন্ধ করার জন্য কঠর আইন আছে কিন্তু মানুষ ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট অপরাধ করে তার আত্মিক অপবিত্রতা ও অন্তরের লালসা দ্বারা তাড়িত হয়ে। সমাজে যত অশ্লীলতা ও ব্যাভিচারের প্রসার ঘটবে মানুষের লালসা তত বৃদ্ধি পাবে ফলে ধর্ষণের মতো ঘটনাও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় অশ্লীলতা ও ব্যাভিচার বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেই বরং বিভিন্নভাবে অশ্লীলতার বিস্তার ঘটানো হয় এবং ব্যাভিচারের প্রসার ঘটানো হয়। যে কোনো অপরাধ দূর করতে হলে তিনদিক দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। সমাজ থেকে ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে প্রথমত বিয়ে সহজ করতে হবে যেন জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য অন্য কোথাও গমন করা না লাগে, মানুষকে কামরিপু নিয়ন্ত্রণের জন্য নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে যেন তার আত্মা ভেতর থেকে এই পাপকাজে বাধা দান করে। এরপর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। – এটা হলো ভারসাম্য।
চুরি বন্ধ করতে হলে প্রথমে মানুষের অভাব দূর করতে হবে যেন কেউ চুরি করতে বাধ্য না হয়। এরপর আত্মিকভাবে প্রত্যেককে চুরি না করার শিক্ষা দিতে হবে, যেন ভেতর থেকে প্রতিটা মানুষের আত্মা চুরি করার ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করে। এরপরও চুর করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। – এই হলো ভারসাম্য। এই ভারসাম্য যে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা যাবে সেখানে আর এই অন্যায়গুলো হবে না। এভাবে প্রতিটা অন্যায়, অপরাধের জন্যই ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা করা না গেলে দিনকে দিন অন্যায় বাড়তেই থাকবে। প্রকৃত ইসলাম হলো ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা (দীনুল ওয়াসাতা)। ইসলামের সঠিক শিক্ষাই পারে সমস্ত অন্যায়, অবিচার দূর করতে।
পাশ্চাত্যদের কাছে আত্মিক শিক্ষার কোনো গুরুত্ব নেই (তারা আত্মায় বিশ্বাসী না)। বিয়ে ব্যবস্থা তারা প্রায় বিলুপ্ত করে ফেলেছে। এবার অবাধ করে দিয়েছে যৌন সম্পর্ক। তাদের ধারণা- যেহেতু যৌন চাহিদা মিটানোর জন্য মানুষ অন্যের উপর জোর-জবরদস্তি করে তাই এটাকে অবাধ করে দিলে মানুষ আর কারো উপর জবরদস্তি করবে না, সুতরাং ধর্ষণও হবে না। আসলে রিপুগুলো এমন নয় বরং ঠিক এর উল্টো। প্রাপ্তিতে লালসা আরও বৃদ্ধি পায়, নিয়ন্ত্রণে তা কমে। কিন্তু শুধুই নিয়ন্ত্রণ অপ্রাকৃতিক, তাই ভারসাম্যপূর্ণভাবে অভাবও মেটাতে হবে। পাশ্চাত্যদের ঐ ধারণা যে ভুল এবং তাদের ঐ কার্যের ফল যে উল্টো হচ্ছে তা আজ প্রমাণিত।
আমাদের আইন, বিচার ও শাসনব্যবস্থা পাশ্চাত্যদের অনুকরণে তৈরি, এর মাধ্যমে মানুষের আত্মার কোনো সংশোধন করা হয় না, উল্টো আমরা দেখি- একটা চোর যদি কিছুদিন জেলে থাকে তবে ডাকাত হয়ে বের হয়, ছোট অপরাধী জেল থেকে বের হয়ে বড় অপরাধের সাথে জড়িত হয়, আইনের ফাঁক-ফোকর খুঁজে নতুন নতুন অপরাধে জড়িত হয়। এ কারণে প্রচলিত আত্মাহীন ব্যবস্থায় দিনকে দিন অপরাধ বেড়ে চলেছে। অপরদিকে ধর্মগুলিও আজ মানুষের আত্মা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল কিছু প্রথার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, এ কারণে ধর্মগুলিও মানুষের আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে যাবতীয় অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারছে না। মানবরচিত আত্মাহীন ব্যবস্থাগুলির মতোই ধার্মিকরাও কেবল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে, ইসলামী শরিয়াহ আইন (যদিও সেগুলো অনেকাংশেই কোর’আন, হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চোরের হাত কেটে আর ব্যাভিচারীদের পাথর নিক্ষেপ করে সমাজ থেকে সকল অপরাধ দূর করতে চায়। ইসলামের ব্যক্তিগত আমলগুলিও মানুষের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতে চায় অথচ আল্লাহ বলেছেন, “দীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই” (সুরা বাকারা- ২৫৬)।
যে ব্যবস্থাতেই জবরদস্তি থাকবে সেটা মানুষের আত্মায় স্থান পাবে না, মানুষ সেটাকে ভয় করবে, ভালোবাসবে না। যখনই ধর্মগুলি জবরদস্তিমূলক হয়েছে তখন তা আত্মাহীন হয়ে গেছে, সেটা মানুষের নির্যাতনের কলে পরিণত হয়েছে। নবী-রসুল, অবতারগণ এসে ধর্মের আত্মা ফিরিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ ধর্ম থেকে জবরদস্তি দূর করে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাটা আত্মায় স্থাপন করে গেছেন, তখন মানুষ আত্মার তাগিদেই অপরাধ থেকে বিরত হয়েছে, সমাজে ন্যায়-সুবিচার-শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...