হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা থেকে কতটুকু শিক্ষা নিচ্ছি?


মোহাম্মদ আসাদ আলী:
আজ থেকে ১৩৭৭ বছর আগে ইরাকের কারবালার প্রান্তরে সপরিবারে নবীর প্রিয় দৌহিত্র হোসাইনের বিষাদময় শাহাদাৎ বরণের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায় হয়ে আছে। এই দিনটিতে শিয়া সম্প্রদায় তাজিয়া মিছিলসহ বিভিন্ন মিছিল, মাতম ও শোকানুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে, ‘হায় হোসেন হায় হোসেন বলে’ বুক চাপড়ে, নিজের শরীর নিজে রক্তাক্ত করে শোক প্রকাশ করে, হায় হুতোশ করে। এত আনুষ্ঠানিকতার মাঝে চাপা পড়ে যায় দিনটির ঐতিহাসিক শিক্ষা। অন্যদিকে সুন্নিদের মধ্যে ভিন্ন চিত্র। তাদের কাছে এই দিনটির তেমন কোনো আবেদন পরিলক্ষিত হয় না। অন্যান্য সরকারি ছুটির মতই দেখা যায় এই দিবসটিকেও তারা সাধারণ একটি ছুটির দিন বলে মনে করে। খায়-দায়, ঘুমায় ও আনন্দ ফূর্তি করে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় উম্মতে মোহাম্মদীর ইতিহাসের এই মর্মান্তিক ঘটনাটির প্রকৃত যে গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনীয় ছিল, তা না শিয়ারা অনুধাবন করতে পারে, না সুন্নিরা। এদিকে আজ সমগ্র মুসলিম উম্মাহ আক্রান্ত, রক্তাক্ত। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো একের পর এক মুসলিম দেশ দখল ও ধ্বংস করে চলেছে, লাখ লাখ মুসলিমকে হত্যা করছে, বাড়িঘর গুড়িয়ে দিচ্ছে, আবার এই জাতি নিজেরাও একে অপরকে কাফের, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে। জাতিগতভাবে পৃথিবীময় মুসলিম জাতির এই যে দুর্দশা, এমন তো হবার কথা ছিল না। কেন এই করুণ পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে তাদের?
এ প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা পেতে চাই তবে উম্মতে মোহাম্মদীর গৌরবগাঁথা ইতিহাসের পাশাপাশি আশুরার এই কলংকজনক অধ্যায়টিরও সঠিক পর্যালোচনা করতে হবে। আল্লাহর রসুল সারাটিজীবন সংগ্রাম করে গেছেন মানবজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য। উম্মতে মোহাম্মদীর উপরও একই দায়িত্ব। কিন্তু যখন ইতিহাসে দেখি আল্লাহর রসুলের ওফাতের কয়েক দশক পর নবীজীর দৌহিত্রকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, তখন আরও একটি প্রশ্ন স্বভাবতই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে, খোদ নবীর পরিবার-পরিজনই যদি এতখানি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তবে অন্যদের অবস্থা কেমন ছিল? তাহলে কি উম্মতে মোহাম্মদী তাদের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল? আজকের এই ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে ঘটনাটির সঠিক মূল্যায়ন করা অতিব জরুরি হয়ে পড়েছে।
ইসলামের চূড়ান্ত সংস্করণ নিয়ে আখেরী নবী, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) এমন এক সময় পৃথিবীতে এসেছিলেন, যে সময়কে আমরা বলি ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞানতার যুগ। এমন নয় যে সে যুগের মানুষ সম্পূর্ণ ধর্মবিমুখ হয়ে গিয়েছিল, আল্লাহ বিশ্বাস করত না, এবাদত-বন্দেগী করত না ইত্যাদি। তা নয়। তৎকালীন আরবরা ধর্মকর্মে কারও চেয়ে পিছিয়ে ছিল না। তারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করত, ক্বাবা তাওয়াফ করত, নামাজ পড়ত, রমজান মাসে রোজা রাখত, দান-খয়রাত করত, মানত করত, খাৎনা করত এবং নিজেদেরকে মিল্লাতে ইব্রাহীম বলে দাবি করত। কোনো ভালো কাজ শুরু করার আগে উচ্চারণ করত- বিসমিকা আল্লাহুম্মা। অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে ধর্মকর্ম বলতে যা বোঝানো হয় তা ওই সমাজেও ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-আচরণ, এক কথায় অত ধর্মকর্ম থাকার পরও ওই যুগকে জাহেলিয়াতের যুগ বলার কারণ তারা ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করত না। ফলে অন্যায়, অবিচার, হানাহানি, রক্তপাত, শত্রুতা, জিঘাংসা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ভরা ছিল তাদের সমাজ। সেখানে চলত ‘Might Is Right’ এর শাসন। শক্তি যার হাতে, ক্ষমতা যার হাতে, তার কথাই ন্যায় বলে সাব্যস্ত হত। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, একতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, আনুগত্যবোধ- কিছুই ছিল না। কৃষি বা ব্যবসা উভয়ক্ষেত্রেই তারা ছিল অনগ্রসর। অভাব, দারিদ্র, অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর বর্বরতার দরুন তৎকালীন পৃথিবীতে তারা গণ্য হত সর্বাধিক উপেক্ষিত, অবজ্ঞাত ও মর্যাদাহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে। সভ্য জাতিগুলো তাদেরকে দেখত অবহেলা ও ঘৃণার দৃষ্টিতে। আল্লাহর রসুল তাদেরকে ন্যায়-অন্যায় শেখালেন। ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য জানালেন। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মত্যাগী, আত্মোৎসর্গকারী বিপ্লবী হবার প্রেরণা যোগালেন। অনৈক্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করলেন, শৃঙ্খলাবোধ শেখালেন। কীভাবে নেতার কথাকে দ্বিধাহীনভাবে, প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় সে শিক্ষা দিলেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যে আরবজাতিটির মধ্যে এমন বিস্ময়কর পরিবর্তন সাধিত হলো যা সমকালীন বিশ্বে কল্পনারও অতীত ছিল।

মানবজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজটি কেবল আখেরী নবী নয়, তাঁর পূর্বের নবী-রসুলগণও করে গেছেন। বিশ্বনবীর সাথে অন্যান্যদের পার্থক্য কেবল এই যে, অন্যান্যদের দায়িত্ব ছিল সীমিত পরিসরে, যার যার এলাকায় সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে শেষ নবীর দায়িত্ব সমস্ত পৃথিবীব্যাপী (ফাতাহ ২৮)। কিন্তু কাজ সবারই এক, সেটা হচ্ছে মানবজীবনে ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা অর্থাৎ শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহর দেওয়া দ্বীনুল হক্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সেই প্রত্যাশিত ‘শান্তি’ আসবে বলেই এই দ্বীনের নামকরণ করা হয়েছে ইসলাম অর্থাৎ শান্তি। আল্লাহর রসুল তাঁর নবুয়্যতি জিন্দেগীতে যা কিছু বলেছেন ও করেছেন সবই সমাজের নিরাপত্তার জন্য, মানুষের শান্তির জন্য। কিন্তু সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় কোনো মানুষের একার পক্ষে এতবড় দায়িত্ব সম্পন্ন করা অসম্ভব। তাই আল্লাহর রসুল সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমগ্র আরব উপদ্বীপে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার পর বাকি পৃথিবীতেও একইভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার, সুবিচার, সাম্য, মৈত্রী এক কথায় ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করলেন উম্মতে মোহাম্মদীর উপর, যে জাতিটিকে তিনি নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন। বারবার জাতিকে সতর্ক করলেন যাতে তিনি দুনিয়া থেকে চলে যাবার পরও তাঁর সুন্নাহ (শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম) ছেড়ে দেয়া না হয়। বলেছেন- ‘যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করল সে আমার কেউ নয় আমিও তার কেউ নই।’ আল্লাহর রসুল জানতেন এই মহাদায়িত্ব পূরণ করার জন্য উম্মতে মোহাম্মদীর যে জাতীয় চরিত্র দরকার তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান হচ্ছে ‘ঐক্য’। তাই কোনোভাবেই যাতে উম্মাহর ঐক্যে ভাঙ্গন না ধরে সেজন্য সারাজীবন তিনি জাতিকে হাজারো উপদেশ তো দিয়েছেনই, ঐক্যভঙ্গের কোনো কথা বা আচরণ দেখলেই তিনি রেগে লাল হয়ে যেতেন। সর্বশেষ বিদায় হজ্বের ভাষণে, যে ভাষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে শেষবারের মত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, সেখানে পুনরায় বললেন, ‘‘আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর যেমন পবিত্র, তোমাদের একের জন্য অপরের জান, মাল, ইজ্জত ততটাই পবিত্র। আমার পরে তোমরা একে অপরকে খুনোখুনি করে কুফরিতে ফিরে যেও না।’’ আরেকটি হাদীসে রসুলাল্লাহ বলেন, ‘‘আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের আদেশ করেছেন। আমি তোমাদেরকে সেই পাঁচটি কাজের দায়িত্ব অর্পণ করছি।
(১) তোমরা ঐক্যবদ্ধ হবে
(২) (তোমাদের মধ্যবর্তী আদেশকারীর কথা) শুনবে
(৩) (আদেশকারীর হুকুম) মান্য করবে
(৪) (আল্লাহর হুকুম পরিপন্থী কার্যক্রম থেকে) হেজরত করবে
(৫) আল্লাহর রাস্তায় জীবন-স¤পদ দিয়ে জেহাদ (সংগ্রাম) করবে।
যারা এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও দূরে সরে যাবে, তার গলদেশ থেকে ইসলামের বন্ধন খুলে যাবে যদি না সে তওবা করে ফিরে আসে। আর যে জাহেলিয়াতের কোনো কিছুর দিকে আহ্বান করে তাহলে সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথরে পরিণত হবে, যদিও সে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এমন কি নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাসও করে [হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিজি, বাব-উল-ইমারত, মেশকাত]।’’ এখানেও একই কথা। ঐক্য নষ্ট করার অর্থ ইসলাম থেকে বহির্গত হয়ে যাওয়া।
আল্লাহর রসুলের এই শিক্ষাকে, ঐক্যের গুরুত্বকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পেরেছিল বলেই পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাদপদ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বর্বর, দাঙ্গাবাজ, অশিক্ষিত, অসভ্য ও নৈতিকভাবে অধঃপতিত একটি জাতি মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে একটি সভ্য, ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও আধুনিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছিল, একটি ‘সম্ভাবনাহীন উপাদান বা শূন্য’ (পি. কে হিট্টির ভাষায়) থেকে বিরাট এক বটবৃক্ষের জন্ম হতে পেরেছিল। যারা কিছুদিন আগেও ক্ষুদ্রতায় ডুবে ছিল, তারাই এমন সোনার মানুষে পরিণত হলো যাদের নামের শেষে আমরা বলি- ‘রাদিআল্লাহু আনহু ওয়া রাদু আনহুম।’ আল্লাহর রসুলের ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতে গড়া জাতিটি পারমাণবিক বোমের মত বিস্ফোরিত হয়ে তৎকালীন পৃথিবীর দুইটি সুপার পাওয়ার রোমান ও পারস্য সা¤্রাজ্যকে এক এক করে নয়, একইসাথে ঝড়ের মুখে তুলোর মত উড়িয়ে দিল এবং মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তায় পরিণত হলো। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় সমস্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন হলো- যে ইতিহাস লিখতে গিয়ে পাশ্চাত্যের খৃষ্টান প-িতরা বারবার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
ওই জাতি যদি অর্ধপৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করে থেমে না যেত, তবে বলাই যায় আরও কয়েক বছরের মধ্যে তারা বাকি পৃথিবীতেও সত্য, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর নবীর অর্পিত দায়িত্বকে পুরোপুরি সম্পন্ন করে ফেলতে পারত। কারণ তাদের সামনে দাঁড়ানোর মত কোনো শক্তি তখন পৃথিবীতে অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হচ্ছে এমন সময় উম্মতে মোহাম্মদী তাদের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলল। আবু বকর (রা.), উমর (রা.) ও উসমান (রা.) এর খেলাফত পর্যন্ত জাতি ছিল ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু উসমান (রা.) এর শাসনামলের শেষের দিকে শুরু হলো জাতিবিনাশী অনৈক্য, যার জের ধরে খলিফা উসমান (রা.) শহীদ হলেন। জাতি ভুলে গেল ঐক্য নষ্ট করা কুফর, যারা করবে তারা কাফের, তারা ইসলাম থেকেই বহির্গত হয়ে যাবে, জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে যদিও তারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করে। উম্মাহর জাতীয় জীবনে নেমে এলো ভয়াবহ বিপর্যয়। বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রসুল যে ‘ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত’ এর আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটাই বাস্তবে রূপ নিল। উষ্ট্রের যুদ্ধে আম্মা আয়েশা (রা.) মুখোমুখী হলেন হযরত আলী (রা.) এর বিরুদ্ধে (এটি একটি ইহুদি গোষ্ঠীর চক্রান্তের ফসল ছিল, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা এই প্রবন্ধে সম্ভব নয়)। তারপর সিফফিনের যুদ্ধে পুনরায় মুয়াবিয়া (রা.) মুখোমুখী হলেন আলী (রা.) এর বিরুদ্ধে। হাজার হাজার মুসলিমের রক্ত ঝরল মুসলিমদেরই হাতে। এই অনৈক্য, এই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত জাতিকে এমনভাবে পেছনে টেনে ধরল যে, জাতি আর সামনে এগোতেই পারল না। যে প্রচ- গতি নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছিল, মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে অর্ধপৃথিবীর চিত্র পাল্টে দিতে পেরেছিল সেই জাতিই গতি হারিয়ে, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ভুলে গিয়ে এবং নিজেরা নিজেরা সংঘাতে জড়িয়ে স্থবির হয়ে গেল।
কিন্তু ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের যে গরল তারা গলধঃকরণ করে ফেলেছে তার প্রতিক্রিয়া এত সহজে নিঃশেষ হবার নয়। ঐ শত্রুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ এক প্রজন্ম থেকে সংক্রমিত হলো পরবর্তী প্রজন্মে। যে জাতির হাতে দায়িত্ব ছিল সমস্ত পৃথিবীতে ন্যায়, সাম্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীর অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষকে মুক্তি দেওয়া, তারা নিজেরাই মারামারি, খুনোখুনিতে মেতে উঠল। এই ভ্রাতৃঘাতী বিদ্বেষ কত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আশুরার বিষাদময় হত্যাযজ্ঞ। আল্লাহর নবীর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, যিনি কিনা রসুলের কোলে বসে, পিঠে চড়ে খেলা করতেন, যার মস্তকে আল্লাহর নবীর পবিত্র হাতের পরশ রয়েছে, যার সম্পর্কে আল্লাহর নবী বলেছেন যে, হাসান-হোসাইনের সাথে যে ব্যক্তি বিদ্বেষ পোষণ করল সে আমার সাথেই বিদ্বেষ পোষণ করল, নবীজীর সেই অতি আদরের দৌহিত্রের মস্তক ছিন্ন করতেও পাপীষ্ঠদের অন্তরাত্মা কাঁপে নি। জাতি তো সেদিনই দেউলিয়া হয়ে গেছে। এই জাতির পতনের পর্ব তো তখনই শুরু হয়ে গেছে। কারবালার প্রান্তরের ওই পৈশাচিক ঘটনার মাধ্যমে এই জাতির মধ্যে ওই যে অত্যাচারী শক্তি খুঁটি গেড়ে বসল, তা দিনে দিনে আরও পোক্ত হয়েছে। আজ সারা বিশ্ব চালাচ্ছে অত্যাচারীরা। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে যে যেভাবে পারছে বিনাশ করে চলেছে। এদের দেশগুলো দখল করে নিচ্ছে। শিশুদের পাখির মত গুলি করছে, নারীদের সম্ভ্রম কেড়ে নিচ্ছে, বাড়িঘর থেকে উৎখাত করে খোলা সমুদ্রে ডুবিয়ে মারছে। আর যাদের দায়িত্ব ছিল দুনিয়াকে এই অত্যাচারীদের হাত থেকে মুক্ত রাখা, তারা সেই দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে একদল নিজেরা নিজেরা কামড়াকামড়ি করছে, রক্তারক্তি করছে, বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসার চর্চা করে নিজেরা ধ্বংস হচ্ছে অন্যকেও ধ্বংস করছে, অন্যরা ইয়াজীদী শক্তির পদসেবা করছে। শিয়ারা ইরানের নেতৃত্বে হয়েছে এক ব্লক, সুন্নিরা সৌদির নেতৃত্বে হয়েছে আরেক ব্লক। কারো ঘাড়ে চেপেছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, কারো ঘাড়ে চেপেছে রাশিয়া। এখনও যদি এদের হুঁশ না ফেরে তাহলে ঐ শিয়ারা যে পারস্য নিয়ে গর্ব করে সেই পারস্যও থাকবে না, আর সুন্নিরা যে আরব নিয়ে বড়াই করে সেই আরবের গৌরবও নিশ্চিহ্ন হবে। এটা ভবিষ্যদ্বাণী নয়, এটা হলো কর্মফল, পরিণতি।
আজ ২০১৭ সালের যে বিন্দুটিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তাকে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে বিরাট এক ক্রান্তিকাল বলা যায়। সার্বিকভাবে মুসলিম নামক জনগোষ্ঠী গত কয়েক শতাব্দী থেকেই ভয়াবহ দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছে, আর এখন নিছক দুর্দশা নয়, এখন প্রশ্ন এই জাতির বাঁচা-মরার। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভাগ্যে যে অমানিশার ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে তা তো আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। অথচ এই মুসলিম জনগোষ্ঠীই একদা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, শিক্ষা-দীক্ষায় সবার শিক্ষকের আসনে বসেছিল। তাহলে এই করুণ পরিণতি কেন? কোথায় ভুল করেছি আমরা? ঠিক কোন জায়গাটায় পথ হারিয়ে আজকের এই চোরাবালিতে আটকে রয়েছি আমরা? এর উত্তর আমাদেরকে জানতে হবে। ১৩০০ বছর ধরে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা স্মরণ করে হায়-হুতোশ ও মাতম কম হয় নি। তাতে কী লাভ হয়েছে? ন্যায় আজও পরাজিত, আর অত্যাচারী যালেমরা দোর্দ- প্রতাপে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর কারণ আমরা কারবালার ইতিহাসে পড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের পানি ফেলতে অভ্যস্ত, কিন্তু এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে অভ্যস্ত নই। যদি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতাম, যদি নির্মোহ পর্যালোচনা করে সমস্যার গোড়ায় প্রবেশ করতে পারতাম তবে মুসলিমদের জন্য সারা পৃথিবী কারবালায় পরিণত হত না। এ জন্যই কাজী নজরুল বলেছেন, ‘‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাই না।’’ তাই আসুন বৃথা মাতম করা ছেড়ে ত্যাগের মহীমায় উজ্জীবিত হই এবং ফেরকা-মাজহাবের দেয়াল ভেদ করে সমগ্র জাতিকে পুনরায় সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রাম শুরু করি। এটাই হোক আশুরার অঙ্গীকার।

যোগাযোগ:
০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫
০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...