হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আসুন সিস্টেমটাকেই পাল্টাই

আবু ফাহাদ

বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সকল দেশে চলছে অস্থিতিশীল অবস্থা। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, আন্দোলন, ভাঙচুর, হরতাল, জ্বালাও পোড়াও ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি হচ্ছে। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। ক্ষমতাসীন একটা সরকারকে প্রবল আন্দোলন, জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে টেনে হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানো হয়, আরেক দলকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তারা এসে আবার পূর্ববর্তী সরকারের মতোই দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি, অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার ইত্যাদি করতে থাকে। সরকারের বিরুদ্ধবাদীর উপর চলে দমন পীড়ন আর পর্দার অন্তরালে চলে বৈদেশিক প্রভুদের মনোরঞ্জনের প্রতিযোগিতা। চলমান এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখে দেখে মানুষ বিরক্ত, হতাশ। কিন্তু তাদের কাছে কোনো উত্তম বিকল্প নেই। তাই তারা একবার কড়াই থেকে চুলায় লাফিয়ে পড়ছে, আবার বাঁচার জন্য লাফিয়ে কড়াইতে উঠছে। এতে করে দিনে দিনে মানুষের যন্ত্রণা বাড়ছে এবং বাড়বে।
ঠিক অনুরূপ অবস্থা ছিল ইসলাম-পূর্ব আরবের। আরবের গোত্রগুলির মধ্যে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেঁধেই চলত, যা পুরুষানুক্রমে অব্যাহত থাকত। এই শত্রুভাবাপন্ন গোত্রগুলিই যখন আল্লাহর রসুলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হলো, তখন তারা হয়ে গেল বিশ্বজয়ী একটি জাতি। প্রায় নিরক্ষর আরবদের থেকে এমন একটি জাতির উন্মেষ ঘটল যারা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে সকল জাতির শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হলো। বাকি দুনিয়া সভয়-সম্ভ্রমে তাদের দিকে চেয়ে থাকত। রসুলাল্লাহর আনীত আল্লাহর দেওয়া সিস্টেম পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন মানুষগুলোকে ভাই বানিয়ে ফেলল। আধ্যাত্মিক উন্নতির ফলে প্রতিটি মানুষ একেক জন সোনার মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। চুরি, ডাকাতি প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। অভাব, অনটন, দারিদ্র্য দূর হয়ে সমাজে সমৃদ্ধি আসলো। আজ আমরা রসুলাল্লাহর যে সাহাবীদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে জানি, তাঁরা ইসলাম গ্রহণের আগেও কি এমনই ছিলেন? না। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ঠিক তাঁরাই একেকজন মহামানবে পরিণত হন। আজ আমরা তাদের নামের পরে বলি ‘রাদি আল্লাহু আনহুম’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাঁর প্রতি খুশি।
আজকে একদলের উপর অসন্তষ্ট হয়ে অন্যদলের ভোটের বাক্স ভরে দিচ্ছে জনতা, যাদেরকে নির্বাচিত করল তারাও পরীক্ষিত দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাস লালনকারী, বিদেশে অর্থপাচারকারী, ওয়াদাভঙ্গকারী। যাদেরকে পরাজিত করল তারাও এদেরই মতো। এই ক্ষমতার দৌঁড়ঝাঁপে কত প্রাণ গেল, কত রক্ত ঝরল, কত গাড়ি-বাড়ি পুড়ল, কত মানুষ পঙ্গু হলো, কতজন অন্যায়ভাবে জেলে পঁচল! এসব করে মানুষের লাভটা কি হল? এত সহজে অতীত ভুলে যাওয়া মোটেও ভালো লক্ষণ নয়, এত সহজে অতীত ভুলে যাওয়া খুব খারাপ রোগ। এটাতো সুদূর কোনো অতীত নয়, এত নিকট অতীত কিভাবে আমরা ভুলে যাচ্ছি? এই যে নির্বাচনের সংস্কৃতি (Power Game), এ থেকে কি আমরা একবার বেরিয়ে আসতে পারি না? সকলকে বোঝা উচিৎ গণতন্ত্রের নামে এক বিষাক্ত, জীবনঘাতি সিস্টেম আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হোয়েছে। যে সিস্টেম এ একজন সৎ, যোগ্য, প্রকৃত ওয়াদারক্ষাকারী, আমানতদার, নিঃস্বার্থ মানবপ্রেমী, উঠে আসতে পারবে না; এ সিস্টেমে যে যত বেশি অপপ্রচার চালাতে পারে, মিথ্যা প্রচার করতে পারে, কালো টাকা ছড়াতে পারে, পেশিশক্তি ব্যবহার করতে পারে সে নির্বাচিত হয়। সে যত বড় দুর্নীতিবাজ, মিথ্যাবাদী, ওয়াদা খেলাফকারী, দেশের সম্পদ লুন্ঠনকারী, সন্ত্রাস লালনকারী হোক না কেন তাদের কোনো অসুবিধা নাই। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কোনো জালের ফাঁকাগুলি যদি বড় বড় থাকে তাহলে সেটা দিয়ে কোনো ছোট মাছ ধরা সম্ভব হয় না, সেগুলি সব ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। থেকে যায় কেবল বড় বড় মাছগুলি। বর্তমানের নেতা নির্বাচন পদ্ধতিটি একটি জালসদৃশ যার ফাঁকাগুলি অনেক বড় বড়। তাই সমাজে যারা প্রভাবশালী, বিত্তবান, পেশিশক্তিতে বলীয়ান অর্থাৎ সমাজের রুই কাতলারা এই জালের মাধ্যমে জাতির নেতৃত্বপদ লাভ করেন। পক্ষান্তরে যারা চরিত্রবান, ভালো মানুষ, ওয়াদারক্ষাকারী, ভদ্র, সভ্য, কারও ক্ষতি করে না তারা বর্তমানের সমাজে তারা গুরুত্বহীন, সর্বত্র অবদমিত। তারা ছোট মাছের মত জালের ফাঁকা দিয়ে বেরিয়ে যান এবং কখনওই নেতৃত্বে উঠে আসেন না।
প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে প্রথমে একজন টাকা দিয়ে মনোনয়ন পত্র কিনে প্রার্থী হয়, নিজের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপায়, নিজের গুণগান নিজেই প্রচার করে, মিছিল করে, ব্যানার টানায়, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়, মানুষকে তার পক্ষে নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন দেখায়, প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে খুন করার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। শান্তি শৃঙ্খলা বাহিনী তো আছেই, নির্বাচনের কেন্দ্র এবং ভোটের বাক্স পাহারা দেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীও মোতায়েন করতে হয়। পাহারা উঠিয়ে নিলেই বোঝা যায় কে কতটা সভ্য। তখন বোমা মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটবাক্স লুট ইত্যাদি অনেক কিছুই ঘটে। গ্রাম্য মেম্বার থেকে শুরু করে যে কোনো পর্যায়ের নির্বাচনেই এসব ঘটনা ঘটে থাকে। এটাই নেতা নির্বাচনের বর্তমান সিস্টেম, সারা দুনিয়াতে এই সিস্টেম প্রায় একই রকম, শুধু কোথাও সহিংসতা কম, কোথাও বেশি। এখন ধরুন একজন সৎ মানুষ আছেন যিনি বিত্তবান নন, নিজস্ব কোনো লাঠিয়াল বাহিনী নেই, পেছনে প্রভাবশালী গোষ্ঠির মদদ নেই তিনি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বড়ই দুঃশ্চরিত্র, নীতিহীন এবং অনেক টাকার মালিক। এখন এই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কার? অবশ্যই দ্বিতীয় লোকটির। এভাবে প্রতিটি পর্যায় থেকে সাধারণত খারাপ লোকগুলি বিজয়ী হতে হতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আসে। যারা নেতা নির্বাচিত হন তাদের ১০০% ই খারাপ তা অবশ্য নয়, কিছু কিছু ভালো মানুষও যদি কালে ভদ্রে নেতা হন, তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। আর তারাও বেশিদিন তাদের সচ্চরিত্র ধরে রাখতে পারেন না; সিস্টেমটাই এমনভাবে তৈরি যে, কেউ ভালো থাকতে চাইলেই ভালো থাকতে পারেন না।
সর্বোপরি প্রশ্ন হলো- এই সব করে কী পেয়েছে জনতা? সেই তো অবহেলা, বঞ্চনা, দুর্ভোগ দিনকে দিন আরও বাড়ছে। এই জীবন ব্যবস্থা বা সিস্টেম এর মধ্যে যতদিন থাকবেন ততদিন কোনো মুক্তি নাই। এই সিস্টেম এ চলে আমরা দুনিয়াও হারালাম, আখেরাতও হারাবো।
আমাদের সমাজে একটি কথা চালু আছে, আগে নিজে ভালো হন, তারপর দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। এই কথাটি সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন। কারণ একটি জীবনব্যবস্থায় মানুষের সামষ্টিক জীবনের গুরুত্ব সর্বাধিক। ব্যক্তি কখনও সামষ্টিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে পথ চলতে পারে না। জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনের চাপে ব্যক্তি তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারে না। বিশাল এক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যমুনা নদীর তুলনায় এক টুকরো শোলার মতো। সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়, সেটা দ্বারা ব্যক্তিও প্রভাবিত হতে বাধ্য। কাজেই জাতীয়ভাবে আজ আমাদের এমন একটি সিস্টেম দরকার যেখানে শত চেষ্টা করেও কেউ ঘুষ খেতে পারবে না, অন্যায় করতে পারবে না, ওয়াদা খেলাফ করতে পারবে না, কেউ বিপুল সম্পদের মালিক হবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় ঘুমাবে এমন অবিচার সৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও যেখানে থাকবে না। এজন্য আমাদের এই সিস্টেমকে পাল্টাতে হবে। প্রশ্ন হলো, এমন সিস্টেম কোথায় পাওয়া যাবে? এর উত্তর হলো, ¯্রষ্টা আল্লাহর দেওয়া দীনুল হক, সত্য জীবনব্যবস্থাই হচ্ছে সেই সিস্টেম। মানুষ নামক এই প্রাণী সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ, কাজেই কোনো রাস্তায় বা সিস্টেমে সে সুখে থাকবে সেটা ভালো জানেন মহান আল্লাহ। আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমই হচ্ছে সেই সরল পথ, এর নামই তাই আল্লাহ রেখেছেন সিরাতুল মুস্তাকিম বা সহজ-সরল পথ।
অতএব আমাদের উচিত এখন আল্লাহ প্রদত্ত ভারসাম্যযুক্ত জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নেয়া। মানবসৃষ্ট এই গণতন্ত্রকে ধারণ করে আমরা শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করতে পারিনি। ¯্রষ্টা প্রদত্ত সিস্টেম ইতিহাসে একবার অর্ধপৃথিবীতে শান্তিপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। তাই এই সিস্টেম পুনরায় শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করবে এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। তাই সিদ্ধান্ত এখন জনগণকে নিতে হবে। সিদ্ধান্ত পুরোটাই আপনাদের হাতে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...