হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আসল কোরবানি ও পশু জবাই

এম. আমিনুল ইসলাম:
সমস্ত রকম ভাল কাজ, কল্যাণের কাজ মো’মেন মুসলিমদের জন্য। কোরবানি যেহেতু কল্যাণের কাজ সমূহের অন্যতম একটি সুতরাং এটাও মো’মেন মুসলিমদের জন্য হবে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু বর্তমান পৃথিবীর মুসলিম পরিচয়দানকারী জাতি ব্যক্তিজীবনে আল্লাহর কিছু হুকুম মেনে নিয়ে সালাহ, সওম (নামাজ, রোজা) করলেও জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনে তারা আল্লাহর হুকুমকে অস্বীকার ও অমান্য করে পাশ্চাত্য বস্তবাদী সভ্যতা দাজ্জালের হুকুম বিধান মেনে নেওয়ার কারণে তারা মুসলিম নয়, মো’মেনও নয়, বরং তারা কার্যতঃ কাফের ও মোশরেকে পরিণত হয়েছে। সুতরাং তাদের উপর শুধু কোরবানি নয় আল্লাহর কোনো বিধানই প্রযোজ্য নয় সুতরাং তাদের কোরবানি করা না করা সমান কথা।  তাছাড়া যে কোন আমলেরই পূর্বশর্ত হচ্ছে ঈমান। কিসের উপর ঈমান? আল্লাহর সার্বভৌমত্বের উপর ঈমান। অর্থাৎ যারা এই স্বীকৃতি দিল যে, “আমরা আল্লাহর হুকুম বিধান ছাড়া অন্য কারো হুকুম বিধান মানব না”  এবং তাদের জীবন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় তথা মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করল তারাই মোমেন, তাদের জন্যই নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, কোরবানি ইত্যাদি আমল। যাদের এই ঈমান নেই তাদের আমল অর্থহীন।
ঈদ শব্দের অর্থ খুশি বা আনন্দ, আর আজহা শব্দের অর্থ ত্যাগ। অর্থাৎ ঈদুল আজহা হলো আল্লাহর রাস্তায়  ত্যাগ করতে পারার আনন্দ। এটা মিল্লাতে ইবরাহীমের সুন্নাতও বটে। এই দিনে মো’মেন সংকল্পবদ্ধ হবে যাতে সে দীনের প্রয়োজনে সমস্ত মানবজাতির শান্তির লক্ষ্যে তার সবকিছু এমনকি পুত্র-কন্যা ও নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত থাকতে পারে। আরবি  ‘র্কুব’ শব্দ থেকে এই ‘কোরবান’ শব্দটি এসেছে যার অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কাছে যাওয়া, সান্নিধ্য অর্জন করা, নৈকট্য লাভ করা, উৎসর্গ করা, বিশেষ ঘনিষ্ঠ হওয়া, খুব প্রিয় হওয়া, ভালোবাসার পাত্র হওয়া ইত্যাদি। নিজের প্রিয় কোন জিনিসকে স্বেচ্ছায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্যের প্রত্যাশায় আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দেওয়াই কোরবানি। যে বা যারা এই কোরবানি করবে তারা হবে ‘মোকাররাবুন’। আল্লাহর একান্ত প্রিয়, সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতম বিশেষ কিছু সংখ্যক বান্দাকে তিনি পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করেছেন ‘মোর্কারাবুন’ বলে (ওয়াকেয়া- ১৪)। এই কোরবানি হতে পারে পার্থিব কোন সম্পদ বা নিজের অমূল্য জীবন অথবা অন্য যে কোন প্রিয় কিছু। কোর’আনে উল্লেখ রয়েছে যে, আদম (আ:) এর সময়ও কোরবানির প্রচলন ছিল (মায়েদা- ২৭)।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য ঠিক করে দিয়ে বলেছেন, “বল, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে (আন’আম- ১৬২)”। কোরবানির শিক্ষাই  হলো ত্যাগের মহিমায় নিজেকে মহিমান্বিত করা। মানুষের জীবনে ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর যেকোন কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করা  হলো কোরবানি। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনার একমাত্র পথ  হলো ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করার জন্য জান এবং মাল দিয়ে সর্বাত্মক সংগ্রাম করা, যা সকল নবী রসুল এবং মো’মেন মোজাহেদগণ করে গেছেন। যে জন্য ইবরাহীম (আ:) কে আগুনের লেলিহান শিখায় নিক্ষেপ করা  হলো, কোন নবীকে করাত দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত চিরে ফেলা হলো, কোন নবীকে হত্যা করা  হলো, কোন নবীর উম্মতকে ফুটন্ত তেলের কড়াইতে ফেলে দেওয়া  হলো। যুগে যুগে ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে হাজারো মোজাহেদের জীবন, যারা প্রত্যক্ষভাবে না থেকেও বেঁচে আছেন পৃথিবীতে স্বগৌরবে সত্যনিষ্ঠ মানুষদের হৃদয়ের মণিকোঠায়, পথ প্রদর্শক হয়ে আছেন অনাগত মো’মেন মোজাহেদদের। কিন্তু বর্তমানে কোরবানির প্রকৃত আকিদা বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা বুঝতে অক্ষম যে, কোনটি আল্লাহর পথে প্রকৃত কোরবানি আর কোনটি কেবল পশু জবেহ।
কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে আজকের সমাজের নামধারী মুসলিমরা পুরোপুরিভাবেই অজ্ঞ। প্রত্যেক কাজেরই লক্ষ্য থাকতে হবে সঠিক। উদ্দেশ্যবিহীন কোন কিছুরই কোন মূল্য থাকে না। আজকের সমাজে যারা কোরবানি করে, তাদের কেউ নিজেকে অতি উত্তম মুসলিম পরিচয় দেওয়ার জন্য কোরবানি করে, তাদের কোরবানি মূল লক্ষ্যই হলো লোকদেখানো এবং গোশত খাওয়া।
রসুলাল্লাহর পুত্র ইবরাহীম এর মৃত্যুর পর তাঁর কোন পুরুষ বংশধর না থাকার কারণে তাঁর শত্রæরা তাঁকে ‘লেজকাটা’ বলে অপবাদ দিত যা তৎকালীন সমাজের কোন ব্যক্তির জন্য খুব মর্যাদাহানিকর হিসাবে বুঝাতো। মক্কার কাফেরদের এই উক্তির প্রত্যুত্তরে আল্লাহ রসুলকে সুরা কাওছার এর মাধ্যমে বললেন, “আমি অবশ্যই তোমাকে কাওছার (সব কিছুর আধিক্য, বিশেষ কল্যাণের প্রাচুর্য, জান্নাতের একটি প্রস্রবণ) দান করিয়াছি। সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাহ কায়েম কর (চূড়ান্ত সংগ্রামে জন্য চরিত্র সৃষ্টির প্রশিক্ষণ নাও) এবং কোরবানি কর (নিজেকে আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রামে এমনভাবে বিলিয়ে দাও, যার ফলে) নিশ্চয়ই তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীই তো নির্বংশ (হয়ে যাবে)।” আল্লাহর নির্দেশিত কোরবানি হলো দীন প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন সম্পদের মায়া ত্যাগ, শুধুমাত্র সামান্য অর্থে ক্রয়কৃত পশু জবাই নয়।
হজ্বের সময় এই যে পশু জবাই করা হয় তা হলো হজ্বে পালনীয় কয়েকটি বিষয় যেমন এহরাম বাঁধা, সাফা-মারওয়ার মধ্যে তাওয়াফ করা, ক্বাবা ঘর তাওয়াফ করা, পাথর নিক্ষেপ করা, মাথা মুড়ানো ইত্যাদির মধ্যে একটি (বাকারা- ১৯৬)। মিল্লাতে ইবরাহীমের সুন্নাহ হিসাবে মদীনায় হেজরতের পর যখন সেখানে রসুলের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা এল, তিনি প্রতি বছর ১০ জ্বেলহজ্বের দিন পশু কোরবানি করতেন। কিন্তু তখন হজ্বে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয় নি। পরবর্তীতে যখন মক্কা বিজয় হলো, তখনও অন্যান্য এলাকায় অবস্থানরত মুসলিমরা হাজীদের সঙ্গে ঐক্য ও সংহতি  প্রকাশার্থে পশু কোরবানি করতেন। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে, পশু কোরবানি করার প্রকৃত স্থান ক্বাবা ঘরের নিকট। আল্লাহ বলেছেন, “এই সমস্ত আন‘আমে তোমাদের জন্য নানাবিধ উপকার রহিয়াছে এক নির্দিষ্ট কালের জন্য; অতঃপর উহাদের কোরবানির স্থান প্রাচীন গৃহের নিকট (হজ্জ- ৩৩)।
এই জাতি গত ১৩শ’ বছরে কত কোটি গরু ছাগল আর উট বকরি জবাই করেছে তার কোন হিসাব নেই। যদিও এরা এইগুলিকে কোরবানি বলছে কিন্তু আল্লাহর নৈকট্য তো দূরের কথা সামান্য দৃষ্টিও দেন নি। যদি দিতেন তাহলে দুনিয়া জোড়া এদের প্রতি এই লা’নত, অভিশাপ ও গজব থাকতো না, সুতরাং এ জাতিও পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে নিকৃষ্টতম জাতিতে পরিণত হতো না। কাজেই এদের এখন সবার আগে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে গরু ছাগল নয়, নিজেদের জীবন ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব আগে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই এই জাতির সকল প্রকার কোরবানি এবং এবাদত আল্লাহ কবুল করবেন।
তর্কপ্রিয় একটি শ্রেণি রয়েছে যারা বলেন আমাদের কোরবানি আল্লাহর কাছে গৃহীত হয় না তা আপনি কী করে বুঝলেন?
যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। কোরবানি কবুল হলো কি হলো না তা বোঝার জন্য পূর্বে একটি ব্যবস্থা ছিল। আদম (আ.)-এর সময় থেকেই কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট বস্তু বা জন্তুকে কোনো একটি উঁচু স্থান বা পাহাড়ে রেখে আসা হতো। যার কোরবানি আল্লাহপাক কবুল করতেন, সেই বস্তু বা জন্তুটিকে আকাশ থেকে একটি আগুনের ফুলকি এসে জ্বালিয়ে দিত। আর কবুল না হলে যেভাবে যবেহ করেছে সেভাবেই পড়ে থাকতো। ইবরাহীম (আ.) ও তার পরবর্তীতে কুরবানীর পশুকে যবেহ করে কাবার সামনে অথবা উপসনালয়ের সামনে রেখে দিত। সেই রীতি এখনও থাকলে আজকের লোক দেখানো ধার্মিকদের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যেত।
সেটা না হলেও কোরবানি হয় কি হয় না তা বোঝার আরো উপায় আছে, সেটা হচ্ছে সমাজে কোরবানির প্রভাব প্রকাশিত হবে। কোরবানি এসেছে ‘র্কুব’ শব্দ থেকে যার অর্থ নৈকট্য। জীবন ও সম্পদ ত্যাগের দ্বারাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যাবে তাই কোরবানি করার আদেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ যাদের কোরবানি কবুল হবে তারা আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত হবে। পরিণামে তাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে ঐক্য, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব, মমত্ববোধ, সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি থাকবে। আর সেটাই হবে পারস্পরিক ত্যাগ ও কোরবানির সামষ্টিক রূপ। এটাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার প্রমাণ। পক্ষান্তরে যাদের সামষ্টিক ও জাতীয় জীবনে অন্যায় অবিচার, হানাহানি, ষড়যন্ত্র, মিথ্যা, প্রতারণা, যুদ্ধ, রক্তপাত, এক কথায় ভয়াবহ অশান্তি বিরাজ করে তাদের কোনো কোরবানি হয় তা, সেটা যে আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার চূড়ান্ত মহড়া তা বুঝতে অধিক বিদ্যাবুদ্ধি লাগে না। এই অন্যায়পূর্ণ সমাজই বলে দেয় যে, তারা আল্লাহর নিকটে যেতে পারে নি, আল্লাহর কাছ থেকে সরে গেছে। উল্টো তারা শয়তানের নিকটবর্তী হয়ে গেছে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...