হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আত্মসমালোচনা: মো’মেন ও কাফেরের প্রকৃত মানদণ্ড

আল্লাহর চোখে মানুষ দুই প্রকার – মো’মেন ও কাফের। আল্লাহ বলেছেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদের কেউ মো’মেন, কেউ কাফের (সুরা তাগাবুন ২)। এজন্য মানুষের পরকালীন পরিণতিও দুটি – জান্নাত ও জাহান্নাম। পৃথিবীতে মানুষের অবস্থাও দুই রকম – শান্তি ও অশান্তি। সেজন্য মানবজাতির সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ দুটো বিষয়ের সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাত্রা করে যাচ্ছে, তা হলো ন্যায়-অন্যায়ের লড়াই, সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ, বৈধ-অবৈধের ধারণার সংঘাত। আসুন আমরা দেখি, প্রকৃত মো’মেন কারা।
সুরা হুজরাতের ১৫ আয়াতে আল্লাহ প্রকৃত মো’মেনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “মো’মেন শুধু তারা যারা আল্লাহ-রসুলের প্রতি ঈমান আনে, আর সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন-সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ মো’মেন।” মনে রাখতে হবে, আল্লাহ রসুলের প্রতি ঈমান অর্থ হচ্ছে তারা যে সত্য মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছেন সেই সত্যকে জীবনে ধারণ করা এবং আল্লাহর রাস্তায় জীবন-সম্পদ দেওয়ার অর্থ মানুষের কল্যাণার্থে নিজ জীবন ও সম্পদকে উৎসর্গ করা। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) সত্যের ধারক, সত্যের উৎস। কাজেই যারা সত্যকে ধরণ করবে এবং সেই মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করল, সত্যের পক্ষ নিল সেই হচ্ছে প্রকৃত মো’মেন। শেষ পৃষ্ঠার পর: এবার দেখা যাক কাফের কারা। আল্লাহ কোর’আনে কাফেরের সংজ্ঞা দিয়েছেন সুরা মায়েদার ৪৪ নম্বর আয়াতে। তিনি বলেছেন, আল্লাহ যা নাজেল করেছেন তা দিয়ে যারা বিধান দেয় না তারা কাফের। এটি একটি চিরন্তন কথা। কাফের অর্থ সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রসুল প্রেরণ করে তাঁদের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে সত্য পাঠিয়েছেন, সেই সত্যকে যারা প্রত্যাখ্যান করবে তারা কাফের, যারা সেই সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, মিথ্যার পক্ষ অবলম্বন করবে, মিথ্যাকে আলিঙ্গন করবে, সেই সত্যকে গোপন করবে, সত্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে তারা হচ্ছে কাফের। তাদের কাজের দ্বারা সমাজে অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে অর্থাৎ কুফর প্রতিষ্ঠিত হবে। সনাতন ধর্মেও অসুর, রাক্ষস ইত্যাদি শব্দগুলো ঐ কুফরি শক্তিকে বোঝানোর জন্যই বলা হয়েছে।
এই হচ্ছে মো’মেন আর কাফের। এক কথায় দুটো পক্ষ – সত্য আর মিথ্যা। সত্যের পক্ষে যারা তারা মো’মেন, মিথ্যার পক্ষ নিলে কাফের। এই উভয় শ্রেণির লোকেরা বংশসূত্রে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক, যে শাস্ত্র বা কেতাবই পড়–ক, যে উপাসনালয়েই গমন করুক তার ভিত্তিতে কোনো বিভক্তি আল্লাহর কাছে নেই। সত্য গ্রহণ/বর্জনের ভিত্তিতে মানবজাতির এই মু’মিন-কাফের বিভক্তি ছাড়া অন্য যে কোনো বিভক্তি ইসলামবহির্ভুত অর্থাৎ হারাম। সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বাঙালি-অবাঙালি, বাংলাদেশি-ভারতীয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, আর্য-অনার্য, আরব-অনারব, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ইত্যাদি যত ভেদাভেদ দুনিয়াময় প্রচলিত রয়েছে তার সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই।
আল্লাহ বলেন, হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক মর্যাদাবান যে সর্বাধিক মুত্তাকি (সুরা হুজরাত ১৩)। এই মুত্তাকি কারা। মুত্তাকি শব্দটি এসেছে তাকওয়া থেকে। তাকওয়ার অর্থ ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা বেছে বেছে পথ চলা। যিনি এই পথ চলার সময় যত বেশি ন্যায় অন্যায় বেছে চলেন তিনি তত বড় মুত্তাকি। বিদায় হজ্বের ভাষণে তাই মহানবী (সা.) বলেছিলেন, অনারবের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নাই। তাঁর সেই শিক্ষা এখন হারিয়ে গেছে, এখন কেবল জন্মগত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আরবরা অনারবদের উপর ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করছে।
যুগে যুগে কালে কালে আসুরিক শয়তানি শক্তির প্ররোচনায় মানুষের মধ্যে জন্ম নিয়েছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, বুর্জোয়া শ্রেণি যারা কায়েমি স্বার্থে মানুষে মানুষে এসব দেওয়াল সৃষ্টি করেছে। সেগুলোকে ধূলিসাৎ করার জন্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিটি জনপদে আগমণ করেছেন নবী-রসুল-অবতারগণ। তাঁরা এসেছেন পাপপূর্ণ সময়ে ঠিক যেমন আল্লাহর শেষ রসুল (সা.) এসেছিলেন আরবের আইয়ামে জাহেলিয়াতে। সেই সময় আরবসহ সমগ্র পৃথিবীতে মানবজাতির মধ্যে রচিত হয়েছে এমনই হাজার বিভক্তির দেওয়াল। রসুলাল্লাহ (সা.) সেই দেওয়াল ভেঙে ন্যায় ও সত্যের উপরে ভিত্তি করে সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করলেন। তিনি ক্রীতদাস বেলালকে (রা.) কাবার শীর্ষে দাঁড় করিয়ে প্রমাণ দিলেন মানুষের মর্যাদা বংশপরিচয়ে নয়, তার ধারণকৃত আদর্শের ভিত্তিতে নিরূপিত হবে।
এভাবে মানবসৃষ্ট অন্যায়মূলক বিভক্তিকে উঠিয়ে দিয়ে সমস্ত মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করাই ছিল ইসলামের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই আল্লাহর রসুল মোহাম্মদ (সা.) একটি সত্যনিষ্ঠ আত্মত্যাগী জাতি গঠন করেছিলেন, যারা তাঁর ইন্তেকালের পর তাদের জীবন-স¤ম্পদ উৎসর্গ করে স্বদেশ থেকে বেরিয়ে পড়েছিল এবং এমন মহাবিপ্লব সংঘটন করেছিল যার সামনে তৎকালীন পৃথিবীর দুই সুপার পাওয়ার রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য ঝড়ের মুখে তুলোর মত উড়ে গিয়েছিল। তাঁরা অর্ধ-দুনিয়ায় সাম্য, ন্যায় সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
অথচ আজ মুসলমান নামক জনগোষ্ঠীর সামনে সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যটি নেই। সমস্ত বিভেদরেখার ঊর্ধ্বে উঠে সকল জাতি-গোত্র-ভাষা-বর্ণ-বিশ্বাসের মানুষকে সত্যের পক্ষে ঐক্যের ডাক দেওয়ার যে সার্বজনীনতা ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল, তা আজ হারিয়ে গেছে। ইসলাম হয়ে পড়েছে যেন গৃহবন্দী। আকীদা ভুলে গিয়ে দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি ও অতি বিশ্লেষণের কারণে ইসলামের সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য বিগত ১৩০০ বছরে একটু একটু করে বিলীন হতে হতে বর্তমানে এমন শোচনীয় অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে, আল্লাহর দেওয়া সমুদ্রের মত বিশাল ও ঝড়ের মত গতিশীল দীনটি আজ স্থবিরতা ও সংকীর্ণতার চাদরে ঢাকা পড়েছে।
অন্য আর দশটা ধর্মের মতই ইসলামও আজ একটি আচার-আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। সকল সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটন করা যে দ্বীনের লক্ষ্য, সেই দীনটিকেই নতুন নতুন সাম্প্রদায়িকতার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। অন্য ধর্মের অনুসারীদের মত মুসলমানদেরকেও একটি সম্প্রদায়ের খোপে ফেলে তার ভেতরে আবার জন্ম দেওয়া হয়েছে শিয়া-সুন্নি, হানাফি-হাম্বলী, শরীয়তী-মারেফতি, কওমী-আলীয়া ইত্যাদি উপ-সম্প্রদায়ের। অথচ অন্য সব বিভেদের মত এই বিভেদগুলোও নিঃসন্দেহে ইসলামপরিপন্থী।
সর্বদিক দিয়ে বিচেনা করলে মুসলিমরা আবার সেই ইসলামপূর্ব জাহেলিয়াতে গেছে। পাশ্চাত্যের দাসত্ব বরণের পর থেকে তাদের দৃষ্টিতে আজ সত্যমিথ্যা একাকার হয়ে গেছে। আল্লাহর আদেশ আর তাদের কাছে মুখ্য নয়। আমাদেরকে এইসব জাহেলিয়াতের দেওয়াল ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আমরা যদি নব্য জাতিভেদপ্রথা তথা বিভক্তির দেওয়াল ভেঙে বের না হতে পারি তাহলে আমাদের ধ্বংস কেউ রুখতে পারবে না।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...