হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

অনৈক্যের প্রধান কারণ পাশ্চাত্যের অনুকরণ

মোহাম্মদ আসাদ আলী:

পৃথিবীব্যাপী অনৈক্য নামক মহামারির যে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে তার প্রধান রূপকার পশ্চিমা স্রষ্টাহীন, বস্তুবাদী সভ্যতা। পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র রূপের ঝলকে পৃথিবীবাসী আজও মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাদের অনুসরণ করে মানুষ প্রতি পদে প্রতারিত হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এত অন্যায়-অবিচার, অশান্তি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হত্যা-রক্তপাত, যুদ্ধ-বিগ্রহও তাদের সেই মোহ ভাঙতে ব্যর্থ হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষ এখনও তাদেরকে বিশ্বাস করে, তার কাছে শান্তির উপায় অন্বেষণ করে।
পাশ্চাত্য বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি জীবনব্যবস্থা মানবজাতির উপরে প্রয়োগ করেছে। যখন ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম হলো তখন দুনিয়াময় প্রতিষ্ঠিত ছিল রাজতন্ত্র। এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রাথমিকভাবে রাজতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে প্রযুক্ত হলেও এক সময় বাজতে আরম্ভ করে রাজতন্ত্রের বিদায়ঘণ্টা, জন্ম নেয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, যার মূলসূত্র পুঁজিবাদ। এই গণতন্ত্র ইউরোপে ধীরে ধীরে রূপ লাভ করল চরম ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রে। দেখা দিল ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবিচার, ধনী-দরিদ্র ব্যবধান। এই অর্থনৈতিক অন্যায় থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ইহুদি পণ্ডিত কার্ল মার্কস আবিষ্কার করলেন পুঁজিবাদবিরোধী সাম্যবাদ (Communism)। প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদভিত্তিক সামন্তবাদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি করে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয় ইহুদি পণ্ডিত কার্ল মার্কসের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ। পাশাপাশি বিশ্বের কয়েকটি প্রভাবশালী দেশে একনায়কতন্ত্র প্রবল হয়ে সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠল। বাকি দুনিয়া তাদেরকে আখ্যায়িত করল ফ্যাসিস্ট হিসাবে। এক পর্যায়ে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র আঁতাত করে দুটি বিশ্বযুদ্ধ করে হিটলার ও মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদ পরাজিত করল কিন্তু দুনিয়া থেকে একনায়কতন্ত্র একেবারে মুছে গেল না, পেছনের সারিতে গিয়ে অবস্থান নিল। তারপর পৃথিবী প্রধানত দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে গেল- এক প্রান্তে সমাজতন্ত্র অন্য প্রান্তে গণতন্ত্র। কোথাও কোথাও গণতন্ত্রের ধড়ের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের লেজ জুড়ে সাধারণ মানুষকে গিনিপিগ করে অদ্ভুত কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই মানুষকে কাক্সিক্ষত শান্তি দিতে সক্ষম হলো না। পুঁজিবাদে দেশের জনগণের অধিকাংশ সম্পদ গুটিকয় মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয়, বঞ্চিত হয় অধিকাংশ মানুষ, সমাজতন্ত্রেও তাই। দেশের সব সম্পদ জড়ো হয় সরকারের তহবিলে, বঞ্চিত হয় সেই অধিকাংশ মানুষ। সুতরাং অবধারিতভাবে আবারও ঘটে সহিংস বিপ্লব, অভ্যুত্থান- যা কখনও সামরিক, কখনও বেসামরিক। বিংশ শতক জুড়ে চলে সমাজতন্ত্রের আধিপত্য যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছে। অবশেষে নব্বইয়ের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভক্তি ও জার্মানের বার্লিন প্রাচীর ধ্বংসের মাধ্যমে দ্বিতীয় কাতারে গিয়ে দাঁড়ায়, প্রথম সারিতে আসে গণতন্ত্র। বিশ্বের মোড়লিপনা থেকে ছিটকে পড়লেও সমাজতন্ত্র মতবাদ হিসাবে বেশ শক্তিশালী এখনও। সমাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে প্রবেশ করা যে কড়াই থেকে চুলাতে লাফ দেওয়া তা এখন সকলের সামনেই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে অন্যায়, অশান্তি, অবিচারের লেলিহান শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে আছে।
এ সবগুলি জীবনব্যবস্থা মানবজাতির মধ্যে এমন একটি হ-য-ব-র-ল পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে যে ভৌগোলিক রাষ্ট্রগুলি তো বটেই, এমনকি প্রত্যেকটি দেশের মানুষ পৃথক পৃথক মতবাদে বিশ্বাসী, একই মতবাদের মধ্যেও আবার রয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। যেমন সমাজতন্ত্রের মধ্যে রয়েছে মাওবাদ, লেনিনবাদ ইত্যাদি। গণতন্ত্রীদেরও ভাগ আছে যেমন- উদারপন্থী (Liberal), রক্ষণশীল (Conservative), প্রজাতান্ত্রিক (Republican) ইত্যাদি। এভাবে বিশ্বের কোনো দেশ গণতন্ত্র, কেউ রাজতন্ত্র, কেউ সমাজতন্ত্র, কেউ সাম্যবাদ ইত্যাদিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে গিয়ে সে দেশের জনগণ বহুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক ভাগের সাথে অপরভাগের দ্বন্দ্ব হয়েছে, সংঘর্ষ হয়েছে, চূড়ান্তভাবে জন্ম হয়েছে অশান্তিময় পরিস্থিতির।
পৃথিবীকে টুকরো টুকরো করে ভাগ করার অনিবার্য পরিণতি হলো- এক পিতা মাতা আদম ও হাওয়া (আ:) থেকে আগত সন্তানদের মধ্যে সৃষ্টি হলো- আমি আমরা, তুমি তোমরা। তৈরি হলো সীমানা, প্রাচীর। তারা পরস্পর পরস্পরের জাতশত্র“তে পরিণত হলো। প্রত্যেকটা সীমানার মধ্যে এবার নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ভাগ, নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হলো। সীমানা তৈরি করলেই তা ভাঙ্গার প্রবণতা দেখা দেবে। প্রয়োজনই এই প্রবণতা সৃষ্টি করবে। হলোও তাই। আল্লাহ সবকিছু এক জায়গায় রাখেন নি, তাই একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় কিছু মানুষকে বন্দি করলে তারা তো সব কিছু সেখানে পাবে না, তাকে অন্য জায়গায় পাড়ি দিতেই হবে। এই বিভাজনের ফলে সম্পদের বণ্টন হলো ভারসাম্যহীন, এক স্থানে বিরাট সম্পদের অধিকারী অন্যস্থানে অস্বাভাবিক দারিদ্র্য। সৃষ্টি হলো মুদ্রার ফারাক- ডলার, রিয়াল, ইউরো, রুবল, টাকা, রুপি ইত্যাদি। মানুষের মতো মুদ্রাও সীমানায় আটকা পড়লো। সীমানা ডিঙ্গাতে গেলে তার মান-হানি হয়। এর ফলে উন্মুক্ত হলো অবৈধ হুন্ডি ব্যবসা, মানি লন্ডারিং, মুদ্রা পাচার, চোরাকারবারী, ভিসা পাসপোর্ট জালিয়াতি, নোট জালিয়াতি ইত্যাদি অপরাধের দুয়ার।
আর্থিক ও সামাজিকভাবেও পশ্চিমা বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ পৃথিবীতে বৈষম্যের স্তর সৃষ্টি করল। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড, থার্ড ওয়ার্ল্ড, উন্নত বিশ্ব (Developed country), অনুন্নত বিশ্ব (Undeveloped country), উন্নয়নশীল বিশ্ব (Developing country) ইত্যাদি নাম দিয়ে বহুপ্রকার ভাগ করল। এক কথায় এই সভ্যতার গতিই হলো অনৈক্যমুখী।
দীর্ঘ চার শতাব্দীর অধিক সময়ব্যাপী পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা এভাবে মানবজাতির মধ্যে বিভেদের মন্ত্রণা ছড়িয়েছে, আজও ছড়াচ্ছে। এবং এটা নিঃসন্দেহে বলাই যায় যে, এ সভ্যতা যতদিন থাকবে ততদিন সে কেবল বিভেদের মন্ত্রই শেখাবে, একই স্রষ্টার সৃষ্টি, এক পিতা-মাতার সন্তান মানবজাতিকে কেবল শত্র“তা, বিদ্বেষ, হানাহানি, রক্তারক্তি আর যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যাপৃত রাখবে। এভাবে কোনো মানবসমাজ চলতে পারে না। যে কোনো জাতির টিকে থাকার জন্য, উন্নতি-প্রগতি-সমৃদ্ধির জন্য ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। তাই মানবজাতিকে এখন একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে, তারা আসলে ঐক্য চায় কি না? যদি পৃথিবীর মানুষ এখনও ঐক্যবদ্ধ না হয় তাহলে অচিরেই তাদের অস্তিত্ব ধুলোয় মিশে যাবে, আর যদি তারা ঐক্যবদ্ধ হতে চায় তাহলে সে ঐক্যের ভিত্তিই হতে হবে- পশ্চিমা ‘সভ্যতা’কে প্রত্যাখ্যান করা, স্রষ্টার বিধানকে বরণ করে নেওয়া।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...