হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সওমের সঠিক আকীদা ও গুরুত্বের ওলট-পালট

মোহাম্মদ আসাদ আলী:
বর্তমানে সওমের মাস আসলে ব্যাপক আয়োজন শুরু হয়, গণমাধ্যমগুলো ক্রোড়পত্র বের করে, প্রতিদিন পত্রিকায় বিশেষ ফিচার, প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখা শুরু হয়। টেলিভিশনে জাদরেল মাওলানা, মৌলভীরা আলোচনার ঝড় তোলেন। কিছু ডাক্তার আসেন সওমের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা বোঝাতে। সারারাত চলে হামদ ও নাত, শেষরাতে সেহেরি অনুষ্ঠান। সব মিলিয়ে বিরাট এক হুলুস্থুল পড়ে যায়। এটা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য, কারণ ইসলামের একটি বিষয় যত বেশি আলোচিত হবে, সেটা মানুষের জীবনেও তত বেশি আচরিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যেখানে আল্লাহ কোর’আনে সওম ফরদ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন মাত্র একবার (সুরা বাকারা ১৮৩) আর সওম পালনের নিয়ম কানুন উল্লেখ করেছেন পরবর্তী চারটি আয়াতে (সুরা বাকারা ১৮৪-১৮৭)। আর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তথা জেহাদ ফরদ হওয়ার কথা বলা হয়েছে বহুবার আর এর বিবরণ দেওয়া হয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক আয়াতে। মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যেও আল্লাহ জেহাদকে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘মো’মেন শুধুমাত্র তারাই যারা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি ঈমান আনার পর আর সন্দেহ পোষণ করে না এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে (সুরা হুজরাত ১৫)।’ এ সংজ্ঞাতে আল্লাহ সওমকে অন্তর্ভুক্ত করেন নাই, জেহাদকে করেছেন। শুধু তাই নয়, সওম পালন না করলে কেউ ইসলাম থেকে বহিষ্কার এ কথা আল্লাহ কোথাও বলেন নি, কিন্তু জেহাদ না করলে আল্লাহ কঠিন শাস্তি দিবেন এবং পুরো জাতিকে অন্য জাতির গোলামে পরিণত করবেন (সুরা তওবা ৩৯)।
আল্লাহ যে বিষয়টি একবার মাত্র করার হুকুম দিলেও সেটা অবশ্যই ফরদ ও গুরুত্বপূর্ণ কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে বিষয়টি একইভাবে ফরদ করা হলো এবং সেই কাজের বিষয়ে শত শতবার বলা হলো সেটির গুরুত্ব আর দুই তিনটি আয়াতে যে বিষয়টি বলা হলো এই উভয় কাজের গুরুত্ব কি সমান? নিশ্চয়ই নয়। মহান আল্লাহ কোর’আনে শত শতবার জেহাদ কেতাল সম্পর্কে বলার পরও এ প্রসঙ্গে কেউ একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না। মিডিয়াতে তো প্রশ্নই ওঠে না, এমন কি যে এমাম সাহেব মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে সিয়ামের ফজিলত নিয়ে সুরেলা ওয়াজে শ্রোতাদের মোহিত করেন, ভুলেও জেহাদের নাম উচ্চারণ করেন না।
এর কারণ কি? এর কারণ সওম অতি নিরাপদ একটি আমল যা করলে সুঁইয়ের খোঁচাও লাগার আশঙ্কা নেই। এতে জীবনের ঝুঁকি নেই, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই, কোন কোরবানিরও প্রশ্ন নেই। পক্ষান্তরে জেহাদ এমন একটি কাজ যা করতে গেলে জীবন ও সম্পদের সম্পূর্ণ কোরবানি প্রয়োজন। আরেকটি কারণ হলো আজকের, দুনিয়াময় যে ইসলাম চালু আছে এটা আল্লাহ ও রসুলের ইসলাম নয়। ব্রিটিশরা মাদ্রাসা বসিয়ে নিজেরা সিলেবাস তৈরি করে এই জাতিকে যে বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে এটা সেই ইসলাম। এতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা তওহীদ নেই, দীনুল হক প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নেই, কোনো জাতীয় আইন-কানুন নেই, দ-বিধি, অর্থনীতি নেই; অর্থাৎ নামাজ, রোজা আর ব্যক্তিগত আমলসর্বস্ব অন্যান্য ধর্মের মতোই একটি ধর্মে পরিণত হয়েছে। এই ধর্মের প-িতদের, আলেমদের কাছে দীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামাজ, রোজা, দাড়ি, তারাবি, টুপি, টাখনু, মিলাদ, মেসওয়াক ইত্যাদি আর জেহাদ একেবারেই নি®প্রয়োজন। এজন্য তাদের এই ইসলাম একটি মৃত, আল্লাহর রসুলের ইসলামের বিপরীতমুখী ধর্ম। এই বিকৃত ধর্মের উপাসনা ও আনুষ্ঠানিকতাগুলো মানুষ পালন করে আল্লাহর কাছ থেকে বিনিময় ও জান্নাত পাওয়ার আশায়। পবিত্র রমজান মাসে এই সমস্ত আমলের প্রতিদান অন্য সব মাসের চেয়ে সত্তর গুণ হবে এই আশায় ধর্মপ্রাণ মানুষ ফরদ, ওয়াজেব, সুন্নাহ, নফল, মোস্তাহাব ইত্যাদি সর্বপ্রকার আমল প্রচুর পরিমাণে করে থাকেন এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করছেন বলে পরিতৃপ্ত থাকেন। কিন্তু সেই আমল গৃহীত হবে কী করলে সেটা কেউ ভেবে দেখে না। তওহীদহীন ইসলাম আল্লাহর কাছে গৃহীত নয় ফলে জাতিগতভাবে আমাদের মো’মেন থাকা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। আরেকটি মারাত্মক বিষয় হচ্ছে গুরুত্বের ওলটপালট। আল্লাহ এবং তাঁর রসুল যে বিষয়ের অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন, এই বিকৃত ইসলামে তাকে একেবারে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়েছে; পক্ষান্তরে আল্লাহ-রসুল যে কাজের গুরুত্ব দিয়েছেন কম, সেটিকে মহাগুরুত্বপূর্ণ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
জেহাদ সংক্রান্ত আলোচনা না করায় কী ক্ষতি হচ্ছে?
জেহাদ সংক্রান্ত আলোচনা কোর’আন ও হাদিসের বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে। এটা নিয়ে যখন মিডিয়া, রাষ্ট্র এমনকি আলেম সমাজ, মসজিদের ইমামগণ প্রায় নিরব ভূমিকা পালন করেন তখন জেহাদের সঠিক আকিদা সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। জেহাদ যে আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, জেহাদ এবং সন্ত্রাস যে ভিন্ন বিষয়, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড ও জেহাদ যে সম্পূর্ণ বিপরীত- এ বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের অজানাই থেকে যায়। এই অজ্ঞতার সুযোগই নেয় জঙ্গিরা। ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে জেহাদের আয়াত ও হাদিস দেখিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেয়। তাদেরকে বোঝানো হয়- দেখ, দেখ জেহাদের কত গুরুত্ব, কত মাহাত্ম্য অথচ তোমার মসজিদের ইমাম তো কখনোই এই কথাগুলো তোমাকে শেখায় নি। তখন ধর্মপ্রাণ মানুষ এটাতে উদ্বুদ্ধ হয়। এজন্য সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে জেহাদ সংক্রান্ত আকিদা পরিষ্কার করা প্রয়োজন, তাদেরকে বোঝানো দরকার যে, জেহাদ এক বিষয় আর জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস অন্য বিষয়। কাজেই ইসলামে জেহাদ এর মানে কী, কেন জেহাদ করবে, কার বিরুদ্ধে করবে, কী দিয়ে করবে ইত্যাদি শিক্ষা ধর্মপ্রাণ মানুষকে দিতেই হবে। এটা এখন সময়ের দাবি।
পরিশেষে কথা হচ্ছে, রমজানের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে আমি সওমের প্রকৃত আকিদা, উদ্দেশ্য তুলে ধরতে যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম, পারলাম কিনা জানি না। আমি যে কথাটি বোঝাতে চেয়েছি তা হলো, সওম হচ্ছে এমন একটি আমল যা ব্যক্তিকে আল্লাহর হুকুম মানার জন্য মানসিক ও আত্মিকভাবে প্রস্তুত করে। সওমের দ্বারা যে আল্লাহর হুকুম মান্য করা শিখবে না, তার সওম রাখা না রাখা সমান কথা। বর্তমানে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এটাই হচ্ছে।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...