হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আসুন প্রকৃত দেশপ্রেমিক হই

রাকিব আল হাসান:
পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে নানা রং নানা রূপ, তবু যে প্রান্তেই যাই, যত রং, যত রূপই দেখি বারে বারে ফিরে আসি আমার সোনার বাংলায়। প্রভাতের স্নিগ্ধ হাওয়ায় পাখির কিচিরমিচির, শিশির ভেজা ঘন ঘাসের গালিচা, সবুজ ফসলের মাঠ, পাখপাখালির কূজন, কোকিলের কুহু কুহু কলতান, সবুজ গাঁয়ের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া শৈশব স্মৃতিবিজড়িত  স্নিগ্ধ নদী, নদীর চরে অবারিত সবুজের মাঝে ফুঠে থাকা হলুদ সর্ষেফুল, বিকেলের সোনা ঝরা মিষ্টি রোদ্দুর আর গোধূলীর রক্তিম আভা এ সবকিছু যেন আমায় হাত ছানি দিয়ে ডাকে সর্বক্ষণ। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এই বাংলার উর্বর পলি মাটি, এই বাংলার ফলফলাদি, বাংলার জারি-সারি-ভাটিয়ালি গান, বাংলা ভাষা আর বাংলার ইতিহাস এসব যেন আমার মায়ের মতো। যখন মায়ের গর্ভে ছিলাম তখনই বাংলা আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে, অনুরণন সৃষ্টি করেছে আমার ভেতর। আমার মাকে যেমন ভালোবাসি তেমনি আমার বাংলাকে ভালোবাসি, বাংলার মাটিকে, বাংলার প্রকৃতিকে ভালোবাসি। এটি কোনো মেকি, লোকদেখানো ভালোবাসার বুলি নয়, এটি হৃদয় থেকে উৎসারিত অকৃত্রিম ভালোবাসা।
আমার দেশের কোটি কোটি মানুষ এই বাংলাকে এভাবেই ভালোবাসে কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে আমাদের মাতৃসম বাংলাকে অতীতে বহুবার ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে। বহু ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বাংলার মানুষকে নিয়ে, বাংলার মাটিকে নিয়ে। আবহমান কাল থেকে এ এলাকার মানুষের জীবন-যাপন ছিল সহজ সরল। এই সহজ সরল মানুষগুলোকে বিভিন্নভাবে বক্রতা শিখিয়েছে কারা? যারা দুধে ভেজাল দিতে জানত না, মিথ্যা বলতে পারত না, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে জানত না, প্রতারণা কীভাবে করতে হয় বুঝত না সেই মানুষগুলোকে কারা মিথ্যা, ছলচাতুরি, মামলাবাজি শিখিয়েছে, এক ভাইয়ের বিরুদ্ধে আরেক ভাইকে লেলিয়ে দিয়েছে, এক প্রতিবেশির বিরুদ্ধে আরেক প্রতিবেশিকে লাগিয়ে দিয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর আজ আমাদেরকে খুঁজতে হবে।
শিল্পবিপ্লবের আগ পর্যন্ত যে অঞ্চল কৃষি, পশুপালন, মৎস্য ও কুটির শিল্পে উন্নত ছিল সেই অঞ্চলগুলোই সমৃদ্ধ হতো এবং সভ্যতা গড়ে উঠত। আমাদের এ অঞ্চলের মাটি উর্বর, বীজ পড়লেই ফসল হয়, তাই এ অঞ্চল কৃষি ও পশুপালনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিল। নদী-নালা-খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যেত তাই মৎস্য সম্পদেও আমরা ছিলাম সমৃদ্ধ। কুটির শিল্পে বহু পূর্ব থেকেই এ অঞ্চল বিখ্যাত। এ কারণে বহু পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন মেলে আমাদের অঞ্চলে। মুসলমানদের আগমনের পর এ অঞ্চল আরও উন্নত, আরও সমৃদ্ধ হতে থাকে। সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য মুসলিম শাসকদের শাসনামলে এ অঞ্চল এতটাই সমৃদ্ধ ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় যে টাকায় আট মণ চাউল হতো। এ অঞ্চলের মানুষের সমৃদ্ধির কথা বলতে গিয়ে বলে থাকে যে, মানুষের পুকুর ভরা মাছ ছিল, গোয়াল ভরা গরু ছিল, গোলা ভরা ধান ছিল। এ অঞ্চলের সমৃদ্ধি দেখে পৃথিবীর অন্য সব অঞ্চলের মানুষ এখানে আসার স্বপ্ন দেখত, এখন যেমন আমেরিকা, ইউরোপ যাবার স্বপ্ন দেখে। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপের বণিকরা জাহাজপথে তাদের বহু দিনের স্বপ্ন পূরণ করতে চলে আসে আমাদের এই উপমহাদেশে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, ফরাসিরা এ অঞ্চলে আড়াইশ’ বছর ব্যবসা করে এ অঞ্চল সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, কূটকৌশলের মাধ্যমে এ অঞ্চলের কিছু লোভী, বিশ্বাসঘাতকদের সাথে হাত মিলিয়ে এ অঞ্চল শাসন করার নীল নকশা করে। শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর ব্রিটিশ বেনিয়ারা এ দেশের মানুষের উপর এমনভাবে শোষণ চালায় যে মানুষ চরম দুভিক্ষে পতিত হয়ে এক কোটি মানুষ মারা যায়। যেটাকে ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মনোন্তর বলে উল্লেখ করা হয়। এই দুর্ভিক্ষে এ অঞ্চলের একতৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারায়, গ্রামের পর গ্রাম জনমানবশূন্য হয়ে যায়, মৃত মানুষের গোস্ত ভক্ষণ করে বাঁচার চেষ্টা করেছে অনেকে। এই দুর্ভিক্ষের বছরেও তারা আমাদের নিকট থেকে প্রায় সমান হারেই খাজনা আদায় করেছে। মানুষ যখন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে থাকে তখন তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করে। এই অঞ্চলের মানুষদের পুরোদস্তুর গোলাম বানানোর জন্য তারা প্রধানত যে কূটকৌশলগুলো করে তা হলো- শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বিকৃত ইতিহাস রচনা, এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিভাজিত করে দেওয়া, তরুণদেরকে মাদকের নেশায় বুদ করে রাখা।
ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে এ অঞ্চলে শিক্ষার যে ধারা চালু ছিল তার মূল ভিত্তি ছিল ইসলাম, সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্ম। ধর্ম থেকে তারা নীতি-নৈতিকতা শিক্ষার মাধ্যমে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, বদান্যতা, দয়া, মায়া, ভালোবাসা ইত্যাদি শিখে সত্যিকার মানুষ হতো। তখন পর্যন্ত মুসলমানরাই ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সব দিক থেকে সবচেয়ে উন্নত জাতি। কাজেই নীতিশিক্ষার পাশাপাশি ভাষা, বিজ্ঞান, গণিত, আইন, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, যুদ্ধনীতি সব কিছুই শিক্ষা করার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা ঐ সময়ের সকল শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করে নিজেদের সুবিধা মতো দুইটি ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করল। একদিকে ইসলাম শিক্ষার নাম করে ১৭৮০ সনে কোলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করল আর অন্যদিকে তাদের তৈরি সিস্টেমে পরিচালিত অফিস-আদালত পরিচালনার জ্ঞান অর্জনের জন্য সাধারণ শিক্ষা চালু করল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম, আর মুসলিমদের বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল- ইসলামের শিক্ষা। এ কারণে ব্রিটিশরা মূলত মাদ্রাসাশিক্ষার মাধ্যমে এমন একটা শ্রেণি তৈরি করতে চাইল যারা মাদ্রাসা থেকে ব্রিটিশদের তৈরি একটা ‘ইসলাম’ শিখে সাধারণ মুসলমানদেরকে তা শেখাবে। ব্রিটিশদের তৈরি ইসলাম যখন মুসলিমরা শিখবে তখন তারা আর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারবে না বরং নিজেরা নিজেরাই ছোটখাট বিষয় নিয়ে তর্ক, বাহাস, মারামারি, কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে থাকবে।
অপরদিকে সাধারণ শিক্ষা (স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি থেকে আমরা যে শিক্ষা গ্রহণ করে উচ্চশিক্ষিত হচ্ছি) এমনভাবে সাজানো হলো যেন এখান থেকে কেউ শিক্ষিত হলে ধর্মের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানতে না পারে, ধর্মের ব্যাপারে বরং বিতশ্রদ্ধ ভাব তৈরি হবে, ব্রিটিশদের প্রতি হীনম্মন্যতা তৈরি হবে আর ব্যক্তিজীবনে তারা হবে চরম স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক (যেহেতু ধর্মের নৈতিক দিকগুলো শিক্ষা দেওয়া হলো না)। এদেরকে সামান্য বেতনে কিনে নেওয়া যাবে।
এভাবে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পুরো জাতিটাকে মানসিক দাসে পরিণত করে আপাত স্বাধীনতা দিয়ে চলে গেল। এখনও পর্যন্ত আমরা তাদের দেওয়া সেই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হচ্ছি, তাদের সেখানো ইসলাম শিখছি, তাদের সেখানো নোংরা রাজনীতি করে যাচ্ছি, তাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে নিয়েছি, পদে পদে তাদের অনুসরণ করে করে আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি।
এখন বিশ^-পরিস্থিতি টালমাটাল। তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের দামামা বাজছে। পরাশক্তিগুলো অস্ত্রের অহংকারে উম্মাদ, কেবল হুমকির ভাষায় কথা বলছে। অন্যদিকে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি নিয়েও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে। এখানে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে দেশ ধ্বংসের পায়তারা চলছে যেমন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে একটার পর একটা মুসলিম দেশ। এই পরিস্থিতে বাংলার মাটিকে নিরাপদ করতে হবে। এ দায়িত্ব বাংলার দেশপ্রেমিক দামাল ছেলেদের। আজকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস আমাদের আছে। ৭১ সালে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা সেই গৌরব গাথা ইতিহাস বর্ণনা করি। সেটা বর্ণনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলে চলবে না। আজকে সেই বীরেরা অধিকাংশই বিদায় নিয়েছেন। তাদের মধ্যেও কিছু মানুষ আজ আদর্শচ্যুত হয়েছে। সেই বীরদের উত্তরসূরি হিসাবে আজ বাংলার দামাল ছেলেদের বজ্রকণ্ঠে হুংকার তুলতে হবে, ষোল কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে দেশ রক্ষার এই মিছিলে। জানি এ কাজ অত্যন্ত কঠিন। কে দেবে সেই হুংকার? কে বাংলার দামাল ছেলেদের জাগিয়ে তুলবে? কে তাদের জীবনের লক্ষ্য ধরিয়ে দেবে? কে তাদেরকে হানাহানি ভুলে, স্বার্থপরতা-আত্মকেন্দ্রিকতা ত্যাগ করে জাতির কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করার শিক্ষা দেবে? এমন প্রেরণা কে সৃষ্টি করে দিবে যাতে তারা তাদের মায়ের পা ধরে এই বলে বিদায় নেয়- ‘দেশের জন্য, ধর্মের জন্য, মানুষের জন্য জীবন দিতে যাচ্ছি মা, তুমি আমার জন্য দোয়া কর, আশীর্বাদ করো। মা তার জন্য রোজা রাখবে, নফল নামাজ পড়বে, পুজো দেবে।’
কারা করবে এ দেশকে রক্ষা? যখন এদেশের রাজনীতিকদেরকে দেখি তখন কোনো আশা পাই না, প্রভুদের শেখানো হানাহানির রাজনীতি, স্বার্থপরতার রাজনীতি তাদেরকে শেষ করে দিয়েছে। যখন শিক্ষিত মহলকে দেখি তখনও আশা পাই না, কারণ এ দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে তারাই, নিজেদের সন্তানকে বিদেশে পড়াচ্ছে, প্রভুদের ভাষায় কথা বলতে তারা স্বাচ্ছন্দবোধ করছে, বিদেশের মাটিতে তারা সেকেন্ড হোক তৈরি করে রেখেছে। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি তাদের কোনো মায়া নেই। যখন মাদ্রাসাশিক্ষিতদেরকে দেখি তখনও আশা পাই না। তারা আছে ধর্মের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে তর্কবাসে লিপ্ত আর ধর্মটাকে বিক্রী করে স্বার্থ হাসিলের ধান্দায়। ব্রিটিশরা যেন সকলকে কিনে নিয়েছে।
আশার কথা হলো- এই দামাল ছেলেদেরকে জাগিয়ে তোলার জন্য যে আদর্শ দরকার তা এই মাটিতে এসে গেছে। কিছু মানুষ এখনো এমন আছে যারা সত্যিই এ দেশকে ভালোবাসে, এদেশের মাটিকে ভালোবাসে, মানুষকে ভালোবাসে। দেশের জন্য জীবন দিতেও পারে। এই মানুষগুলো লুকিয়ে আছে সবজায়গাতেই। এই মানুষগুলো যেমন শিক্ষিত জনদের মাঝে আছে, তেমনি কৃষক-শ্রমিক-জনতার মাঝেও আছে, এরা যেমন শিক্ষকদের মাঝে আছে তেমিন ছাত্রদের মাঝেও আছে, এরা যেমন রাজনীতিকদের মাঝে আছে তেমনি সংস্কৃতিকর্মীদের মাঝেও আছে, এরা যেমন মাদ্রাসাশিক্ষিতদের মাঝে আছে তেমনি সাধারণ শিক্ষিতদের মাঝেও আছে। এখন তাদেরকে এক হতে হবে। সকল বাধা-বিপত্তি দূরে ঠেলে দিয়ে তারা যদি এক হতে পারে তবে আর আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে নিয়ে কেউ ষড়যন্ত্র করতে পারবে না। সেটা তখনই সম্ভব যখন দেশকে, মাটিকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসবে- তখন এই কথা বলা সার্থক হবে যে, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।”

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...